নির্বাচনমুখী অভিযাত্রায় গঠন করা হলো সার্চ কমিটি

30 October 2024 3:50 am
সার্চ কমিটি হলেও নির্বাচন কবে হবে বলছে না সরকার।

সার্চ কমিটি হলেও নির্বাচন কবে হবে বলছে না সরকার।

দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর জাতীয় নির্বাচন কবে হবে— এমন প্রশ্ন নিয়ে নানা ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার কথা বলা হলেও এতদিন এ বিষয়ে স্পষ্ট কোন কথা বলেনি অন্তর্বর্তী সরকার। এরইমধ্যে নির্বাচনের জন্য সার্চ কমিটি গঠনের কথা জানালো সরকার। তবে ভোটের দিন তারিখ জানায়নি তারা। 

তবে মঙ্গলবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি সার্চ কমিটি গঠন করেছে। সরকার বলেছে এর মধ্য দিয়েই নির্বাচনমূখী যাত্রা শুরু করেছে তারা।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, এবার আমরা ভুয়া নির্বাচন করবো না। এবার অবাধ, অসাধারণ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন করবো। ভোটার তালিকা হালনাগাদে সময় লাগবে। আর সংস্কারের সাথে নির্বাচনকে কীভাবে সম্পৃক্ত করা হবে, তা দেখতে হবে।”

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা, সংবিধান সংস্কারসহ রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংস্কারে ছয়টি কমিশন গঠন করছে। সেই কমিশনগুলো এখনো কাজ করছে।

এই অবস্থায় নির্বাচনমূখী যাত্রা শুরুর ঘোষণা দিলেও এখনো নির্বাচনের কোন সময় সীমার কথা বলেনি সরকার।

যে কারণে প্রশ্ন উঠছে সরকারের এই ঘোষণা কতখানি বাস্তবসম্মত?

নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে আমরা আমাদের কাজ শুরু করেছি। আমাদের চেষ্টা আছে ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে সংস্কার প্রস্তাবনা সরকারের কাছে জমা দিতে।

কিন্তু নির্বাচনি ব্যবস্থা কিংবা সংবিধান কত দিনের মধ্যে সংস্কার শেষে নির্বাচন হবে সে নিয়ে রাজনীতির মাঠেও এক ধরনের ধোঁয়াশা আছে।

যে কারণে আগামী নির্বাচনের একট রোডম্যাপ প্রকাশে গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কবে যাব এটা নিয়ে কিছু দুশ্চিন্তা রয়েছে। সে নিয়ে একটা ধারণা দেয়ার জন্য সরকারের একটা রোডম্যাপ এখনই ঘোষণা করা উচিত।

ঢাকায় নির্বাচন কমিশন ভবন
নির্বাচন কমিশন ভবন, ঢাকা

নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা যে কারণে?

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর গত আড়াই মাসের বেশি সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে দুই দফায় সংলাপ করেছে।

এতে আগামী নির্বাচন কিংবা নির্বাচন কেন্দ্রীক সংস্কার নিয়ে নানা বিষয়ে আলোচনা হলেও আগামী নির্বাচন কবে হবে, সে নিয়ে কোন স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি।

এ নিয়ে সরকারের উপদেষ্টাদেরও ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেছে গত গত দুই মাসে।

মঙ্গলবার আসিফ নজরুল সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু কথা বললেও ভোটের দিন তারিখ কিংবা নির্বাচন কমিশনের পরবর্তী কার্যক্রম নিয়ে কোন কথা বলেননি।

অপরদিকে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি এই ‘প্রোক্লেমেশন অব রিপাবলিক’ বা রাষ্ট্রীয় ফরমান জারির মাধ্যমে সংবিধান স্থগিতের দাবিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠক করছে।

ছাত্র নেতাদের চাপের কারণে যদি শেষ পর্যন্ত সংবিধান স্থগিত হয়, তাহলে কোন সংবিধান অনুযায়ী আগামী নির্বাচন হবে সেই প্রশ্নও নতুন করে তৈরি হচ্ছে।

অপরদিকে নির্বাচন সংস্কার কমিশনও এমন কিছু পরিবর্তনের কথা বলছে যাতে সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজন হতে পারে।

এই অবস্থায় সরকার নির্বাচনমূখী যাত্রা শুরু হলে নতুন কোন সংকট তৈরি হবে হবে কী না সেই প্রশ্নও সামনে আসছে।

নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমাদের দেয়া সংস্কার প্রস্তাবের ভিত্তিতে কাজ করবে নতুন নির্বাচন কমিশন। তবে এসব সংশোধনের আগে দরকার রাজনৈতিক ঐকমত্য।

বিএনপি বলছে, আগের নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগের পর নতুন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভোট নিয়ে এক ধরনের ঢিলেমি করেছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সার্চ কমিটি যেন বেশি সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভোটের আয়োজন করে। তাতে মানুষের মধ্যে নির্বাচনকেন্দ্রীক দুশ্চিন্তা দূর হবে।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়া গত তিনটি নির্বাচন নিয়ে ছিল নানা প্রশ্ন

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়া গত তিনটি নির্বাচন মোটের ওপর ভোটারবিহীন ছিল।

নির্বাচনি সংস্কার কতদূর?

বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে চলতি মাসের শুরুতেই দায়িত্ব শুরু করে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিটি। শুরুতে এই কমিটি নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগে সার্চ কমিটি সংক্রান্ত একটি খসড়া আইন প্রস্তুত করেছিল। কিন্তু এই খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার আগেই সার্চ কমিটি নিয়োগ দিয়েছে সরকার।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিটির একজন সদস্য বলেন, “এখন হয়তো আমাদের খসড়াটি কোন কাজে আসবে না। তবে একটা অস্বাভাবিক সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। খসড়াটি আইন আকারে চূড়ান্ত হলে পরবর্তীতে রাজনৈতিক সরকারের সময় নির্বাচন কমিশন নিয়োগের বিষয়টি আরো সহজ হবে।”

গত প্রায় এক মাসে নির্বাচন ব্যবস্থার বেশ কিছু বিষয় সংস্কারের জন্য চিহ্নিত করেছে এই সংস্কার কমিশন। এসব চূড়ান্ত হলেই হালনাগাদ আইনে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবে বলে মনে করছে কমিশনের সদস্যরা।

কমিটির প্রধান মি. মজুমদার বলেন, আমরা শুধু সংস্কারের প্রস্তাব দিলেই তো হবে না। এগুলোতে রাজনৈতিক ঐকমত্যও তো দরকার হবে। সংস্কারের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলোও জরুরি।

বিএনপি বলছে নির্বাচনের জন্য অনেক ধরনের সংস্কার প্রয়োজন হলেও সবগুলো এই সময়ের মধ্যে সম্ভব কী না সেই প্রশ্নও সামনে আসছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ”সরকার ও সংস্কার কমিশনের উচিত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করা। এখন যেগুলো না করলেই না সেগুলোই আগে সংস্কার করা উচিত”।

নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন হবে কবে?

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকার পতনের ঠিক এক মাসের মাথায় গত ৫ই সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। দেশে প্রথমবারের মতো আইন ও সার্চ কমিটির মাধ্যমে বিগত নির্বাচন কমিশন গঠন হলেও তাদের অধীনে হওয়া জাতীয় নির্বাচনসহ বেশ কিছু নির্বাচন নিয়ে ছিল নানা প্রশ্ন।

যে কারণে সরকার পতনের পরই স্বাধীন কমিশন হওয়ায় সত্ত্বেও সরে যেতে হয়েছিল নতুন কমিশনকে। এসব কারণে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন সরকারকে আগামী কমিশন গঠনে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছে বিএনপি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মি. আহমেদ বলেন, ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটা শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। যেটার ওপরে সবার আস্থা থাকবে। “তবে এই সার্চ কমিটি যেন নতুন কমিশন গঠনে অযথা সময়ক্ষেপণ না করে, আমরা সেই দাবিও জানাই” বলছিলেন মি. আহমেদ।

নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন নির্বাচন কমিশন আগে দায়িত্ব নিয়েই দেখবে তাদের আইনে কোন ত্রুটি আছে কী-না। সেটি না থাকলে তারা নির্বাচন আয়োজনের পরবর্তী কাজ শুরু করবে।

নির্বাচন বিশ্লেষক জেসমিন টুলি বলেন, “প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সীমানা নির্ধারণসহ প্রাথমিক কাজ শেষে তারা রাজনৈতিক দল বা সুশীল সমাজের সাথে সংলাপ করবে”।

তবে সংস্কার ও ভোট আয়োজনের পরবর্তী কাজগুলো শেষ করতে কতদিন সময় লাগতে পারে সেটি নিয়ে কিছু প্রশ্ন রয়েছে।

নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “সংস্কার ও নির্বাচন কমিশনের কাজ যদি একই সাথে চলে তাহলে খুব বেশি সময় লাগবে না”।

বিএনপি অবশ্য বলছে, সরকার ও আগামী নির্বাচন কমিশন যদি চায় তাহলে এসব ভোট আয়োজনে বেশি সময় লাগার কথা না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মি. আহমেদ বলেন, “নতুন নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে আমরা সব সময় সহযোগিতা করে যাবো, যাতে একটা অনিশ্চিত পরিবেশ থেকে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার পায় বাংলাদেশ”।

আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল

অন্তর্বর্তী সরকার একটি সুন্দর নির্বাচন দেবে বলে আশাবাদ রাখেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। 

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলছেন, আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যাত্রা শুরু হয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি গঠন হয়ে গেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সই হওয়ার পর বুধবারের মধ্যে প্রজ্ঞাপন হয়ে যাবে।

মঙ্গলবার সচিবালয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্কের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আইন উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, সার্চ কমিটি হয়ে গেলে নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে যাবে।

ভোটার তালিকা নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন রয়েছে। বিগত নির্বাচনগুলোই ছিল ভুয়া। তাই ভোটার তালিকা নিয়ে তেমন কথা হয়নি। এবার ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হবে। একটি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা করা হবে। অন্তর্বর্তী সরকার একটি সুন্দর নির্বাচন দেবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

নির্বাচন দিতে কত সময় লাগবে, তা অনেকগুলো ‘ফ্যাক্টর’–এর (বিষয়) ওপর নির্ভর করবে বলে উল্লেখ করেন আইন উপদেষ্টা।

আসিফ নজরুল বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জাতিসংঘ তাদের পূর্ণ সমর্থনের কথা জানিয়েছে। ফলকার টুর্ক সরকারের সংস্কারকাজেও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে তিনি দুটি প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন। এক. বিচার বিভাগ স্বাধীন করা। দুই. মৃত্যুদণ্ড রহিত করা।