দেশের নতুন নির্বাচন কমিশন শপথ নিল আজ রোববার। এবার এই কমিশন গঠনকে কেন্দ্র করে বিগত বছরগুলোর মতো রাজনৈতিক বিতর্ক দেখা না গেলেও এর গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু প্রশ্ন রয়েই গেছে বলে মনে করছেন অনেকে। স্বাধীনতা লাভের পাঁচ দশক পরও দেশে একটি শক্তিশালী স্বাধীন নির্বাচন কমিশন তৈরি করতে না পারার ব্যর্থতা গণতন্ত্রকামী জনগণের মনে হাহাকার করে ফেরে। এবার যে প্রক্রিয়ায় কমিশনটি গঠিতহলো সেটি নিয়েও প্রশ্ন ও সংশয় তাদের মনে। তারা বলছেন, নির্বাচন কমিশন পারবে কি জনগণের আস্থার জায়গা সৃষ্টি করতে?
বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও চারজন কমিশনারের নিয়োগ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নতুন কমিশনের ওপর আস্থা রাখার কথা জানিয়েছে। দলটির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল শুক্রবার একটি কর্মসূচি শেষে সাংবাদিকদের বলেন, “কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে নির্বাচনি ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়েছে। আমরা নতুন কমিশনের উপর আস্থা রাখতে চাচ্ছি।”
“নতুন ইসিদের কথা কম বলে কাজ বেশি করতে হবে,” যোগ করেন মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল।
একাধিক জাতীয় দৈনিক জানাচ্ছে, বিএনপি ও জামায়াতের প্রস্তাবিত নাম থেকেই সিইসিসহ কমিশনের একাধিক সদস্যকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠনপ্রক্রিয়ায় ‘আগের সরকারের সময়কার মতো চর্চাই’ দেখা গেছে উল্লেখ করে এর সমালোচনা করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।
সেকারণে ‘আস্থার জায়গায় একটু ঘাটতি ও প্রশ্ন থেকে গেলো” বলে মত সুপরিচিত নির্বাচন পর্যবেক্ষক মুনিরা খানের। তবে, রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকলে গঠনপ্রক্রিয়া যেমনই হোক ভালো নির্বাচন করা সম্ভব বলে মনে করেন আরেকজন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আবদুল আলীম।
আবদুল আলীম নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনেরও সদস্য। ইসির জন্য রাজনৈতিক দলগুলো “আরেকটু ধৈর্য ধারণ করলে ভালো হতো” বলে অভিমত তার।
নতুন কমিশন
প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ পেয়েছেন এ এম এম নাসির উদ্দীন। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব। কমিশনার পদে যে চারজন নিয়োগ পেয়েছেন তারা হলেন- অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমানেল মাসুদ, অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব তহমিদা আহমদ এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মুনিরা খান সাংবাদিকদের বলেন, কমিশন গঠনে অতীতের মতোই আমলা নির্ভরতা দেখা গেছে। “আগের মতই সার্চ কমিটি হলো, আগের মতই সাবেক সচিবদের নিয়ে কমিশন, আরো যারা নির্বাচন নিয়ে এতোদিন মাথা ঘামিয়েছে তাদের কোনো প্রতিনিধি আমরা এর মধ্যে দেখতে পেলাম না,” বলছিলেন মিজ খান।
‘সংস্কার কমিশন অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে’
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে কয়েক দফায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে বৈঠক করে। সেসব বৈঠকসহ বিভিন্ন সভা সমাবেশে রাষ্ট্রের নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করতে সরকারকে তাগিদ দেয় রাজনৈতিক পক্ষগুলো।
তবে সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন আগে তা নিয়ে বিএনপি ও বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে মতবিভেদ ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। এদিকে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক মাসের মাথায় পাঁচই সেপ্টেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল ও অন্য চার কমিশনার পদত্যাগ করেন।
তার প্রায় দুই মাস পর গত ৩১শে অক্টোবর আপিল বিভাগের বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি(সার্চ কমিটি) গঠন করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে প্রণীত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইনের অধীনে গঠিত হয় এই কমিটি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০২২ সালে আইনটি করেছিল শেখ হাসিনার সরকার। আইনটি পাসের পরপরই বিরোধীদের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল।
চলতি বছরের অগাস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে যে কমিশন গঠন করা হয়, তারা অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন কমিশন গঠন সংক্রান্ত আইনের সংস্কারকে।
সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার কাজ শুরুর আগে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, “আমাদের পর্যালোচনায় সব বিষয়ই আসবে। কমিশনার ও সিইসি নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে আইনের বিষয়গুলোও আমরা দেখবো”।
তবে সার্চ কমিটি গঠিত হয়ে যাওয়ার পর এই দফায় কমিশন গঠনের জন্য নিয়োগের আইনটির সংস্কার ‘অপ্রয়োজনীয়’ হয়ে পড়ে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও সংস্কার কমিশনের অন্যতম সদস্য আব্দুল আলীম গণমাধ্যমকে বলেন, দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনের জন্য সংস্কারের প্রয়োজন আছে।
“জানি না সরকার কীভাবে চিন্তা করছে। এখন যেহেতু কমিশন গঠিত হয়ে গেছে তারা হয়তো ভাবছে পরবর্তীতে যে কমিশনগুলো গঠিত হবে তাদের বেলায় আইনের সংস্কার প্রযোজ্য হবে,” বলছিলেন আবদুল আলীম।
কমিশন যেভাবেই হোক, তার নেপথ্যে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর একটা ‘কনসেনশাস’ (ঐকমত্য) আছে বলে ধারণা করেন তিনি। নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মুনিরা খানও তড়িঘড়ি করাটাকে সমালোচনার চোখে দেখছেন।
“নির্বাচন কমিশন গঠন বিতর্কের উর্ধ্বে না থাকলে নির্বাচনও বিতর্কের উর্ধ্বে থাকতে পারে না,” গণমাধ্যমকে বলেন তিনি।
তার মতে এর ফলে “সংস্কার কমিশন গঠনটাই অনেকখানি অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে”। নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আবদুল আলীম বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলো চাপ তৈরি করছে, তারা যদি আরেকটু ধৈর্য ধারণ করতো তাহলে ভালো হতো। তাহলে একটা অধ্যাদেশ করে নতুন একটা আইন জারি করা যেত বলে অভিমত তার।
আবদুল আলীম গণমাধ্যমকে বলেন, “এটার অধ্যাদেশ করা খুব সময়সাপেক্ষ হতো না। বড়জোর এক সপ্তাহের বিষয় হতো। এর চেয়ে আরো কমসময়েও করা সম্ভব।”
“আমার কাছে মনে হয় সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলে ভালো হতো,” যোগ করেন তিনি।
সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন সম্ভব?
গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যাপকভাবে বিতর্কিত হওয়ার পর দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে বলে অভিযোগ করে আসছিলো বিরোধী দলগুলো।
যে কারণে ‘ভোটের অধিকার’ ও ‘গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা’র মত শব্দগুলো জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছে। নির্বাচন আয়োজনের মূল দায়িত্বটা থাকে কমিশনের। সংবিধান অনুযায়ী সরকার তাদের ‘সহায়তা’ করার কথা।
আগের নির্বাচনগুলোর বেহাল অবস্থার জন্য কমিশনকে দায়ী করেন অনেকে। সেই একই কায়দায় গঠিত নাসির উদ্দীন কমিশনের পক্ষে ভোটকে বিতর্কের উর্ধ্বে রাখা চ্যালেঞ্জিং হবে, বলছিলেন মুনিরা খান।
“এই কমিশন গঠন নিয়ে বিতর্কটা সবসময় মানুষের মধ্যে থাকবে যদি না কমিশন একটা সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন দিতে পারে,” সাংবাদিকদের বলেন তিনি।
ড. আলীম অবশ্য মনে করেন, রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে তিনি ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের প্রসঙ্গ টানলেন।
তিনি বলেন, “১৯৯১ সালে তো কোনো আইনই ছিল না। কিন্তু একটা আনফিশিয়াল কনসেনসাস ছিল।” “নির্বাচনের ক্ষেত্রে কনসেনসাস গুরুত্বপূর্ণ। কনসেনসাস হয়ে থাকলে আমরা ভালো ফলাফল আশা করতে পারি,” যোগ করেন আবদুল আলীম।
আর নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন বলছেন, “জাতিকে একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন উপহার দেয়াই মূল লক্ষ্য।”
‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করবে কমিশন’
নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে দেবে বলে জানিয়েছেন নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন।
নতুন কমিশনের প্রজ্ঞাপন জারির পর সাংবাদিকদের দেয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নাসির উদ্দীন বলেন, সংকটময় সময়ে দায়িত্ব নিলেও এটি দেশের জন্য কিছু করার একটা সুযোগ হিসেবে দেখছেন তিনি।
তিনি বলেন, আমরা মাঠ তৈরি করে দেবো। যারা নির্বাচনে যেতে চান তারা অংশ নেবেন।
“এখন অনেক চ্যালেঞ্জ দেখছেন, নির্বাচন করতে গেলে ভবিষ্যতে অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে, যখন আসবে তখনই যথাযথ উপায়ে মোকাবেলা করতে হবে,” যোগ করেন সিইসি।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষের তরফ থেকে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ও বিতর্ক চলমান। ক্ষমতাচ্যুত দলটিকে নিয়ে নির্বাচন ইস্যুতে এখনই কোনো মন্তব্য করতে চান না নতুন সিইসি।
গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে। ইলেকশন আসতে আসতে হয়তো সেই বিতর্কের একটা ফয়সালা হবে। আমি এখনো শপথও নিইনি। এখনই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।”