বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা এবং গণভোটের প্রয়োজনীয়তা

ব্যারিস্টার মো. সালাহ উদ্দিন ভুইয়া
31 August 2024 4:55 pm
অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তৃত্বকে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুদৃঢ় করা জরুরি।

অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তৃত্বকে গণভোটের মতো একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুদৃঢ় করা জরুরি।

সম্প্রতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের আকস্মিক পদত্যাগের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পৌঁছেছে। এই পদত্যাগ, যা একটি বৃহত্তর গণ অভ্যুত্থানের ফলে ঘটেছে এবং এতে ৭৫৭ এরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে, (সূত্র-প্রথম আলো) এবং প্রায় ৭২ ঘণ্টা বাংলাদেশ কার্যত সরকারবিহীন  ছিল। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরামর্শের পর নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। যদিও এই পদক্ষেপকে অনেকেই স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় মনে করছেন, কিন্তু এটি সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে একটি তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

সংবিধানিক অস্পষ্টতা

বাংলাদেশের সংবিধান, যা দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে কাজ করে, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভা এবং পার্লামেন্টসহ মূল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষমতা ও দায়িত্ব নির্ধারণ করে। তবে, শেখ হাসিনার সরকার সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে যে নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা ছিল তা বাতিল করে এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয়ে একটি উল্লেখযোগ্য ফাঁক রেখে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে এবং পার্লামেন্ট না থাকলে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয়টি স্পষ্টভাবে সংবিধানে উল্লেখিত হয়নি, যা বৈধতার প্রশ্ন উত্থাপন করে বর্তমান সরকার গঠন নিয়ে।

অনুচ্ছেদ ৭: জনগণের সার্বভৌমত্বের নীতি

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ তে বলা হয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের সমস্ত ক্ষমতা জনগণের এবং এটি সংবিধান অনুযায়ী প্রয়োগ করা উচিত। এই নীতি সরকারী পদক্ষেপগুলিকে সাংবিধানিক ভিত্তিতে পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে, পাশাপাশি জনগণের সার্বভৌমত্বকেও গুরুত্ব দেয়। অন্তর্বর্তী সরকার, যা ব্যাপক জনগণের সমর্থন লাভ করেছে, এটি জনগণের ইচ্ছার একটি বৈধ অভিব্যক্তি হতে পারে, যদিও সংবিধানে এর জন্য স্পষ্ট বিধান নেই।

এই পরিস্থিতিতে আইনের সাংবিধানিক বিপ্লবের ধারণাটি প্রাসঙ্গিক। ইতিহাসে, গুরুত্বপূর্ণ জনসাধারণের অভ্যুত্থান থেকে উদ্ভূত এবং বিস্তৃত সমর্থন পাওয়া সরকারগুলি প্রায়ই বৈধ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে, এমনকি যদিও সংবিধানে তাদের জন্য কোন সরাসরি ব্যবস্থা ছিল না। ৭২ ঘণ্টা  জনগণের নিয়ন্ত্রণ ছিল বাংলাদেশ এবং এই বিপ্লব জনগণের যে অভিপ্রায় তা  বৈধতার একটি বাস্তব অভিব্যক্তি হতে পারে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, অনুচ্ছেদ ৭ এবং বিপ্লবী সরকারের ধারণার মাধ্যমে, এই সরকারকে সাংবিধানিকভাবে বৈধ বলা যেতে পারে।

অনুচ্ছেদ ১০৬: আইনি বৈধতা নিশ্চিতকরণ

অনুচ্ছেদ ১০৬ রাষ্ট্রপতিকে জনস্বার্থের বিষয়গুলোতে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাওয়ার ক্ষমতা প্রদান করে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আগে, রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনের মতামত চেয়েছিলেন যে, এমন একটি সরকার সংবিধান অনুযায়ী বৈধ হতে পারে কিনা। আদালতের মতামত ছিল যে, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ এবং কার্যকরী পার্লামেন্টের অভাবের প্রেক্ষিতে,

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক শূন্যতা দূর করতে এবং নির্বাহী কার্যক্রম সুন্দরভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে এবং রাষ্ট্রপতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টামণ্ডলীকে শপথবাক্য পাঠ করাতে পারেন বলে বিশেষ রেফারেন্সের (১/২৪) মাধ্যমে আপিল বিভাগ মতামত দেয়। (সূত্র-মানব জমিন)।

ডকট্রিন অব নেসেসিটি বা প্রয়োজনীয়তার নীতি এমন পদক্ষেপগুলিকে অনুমোদন দেয় যা বিদ্যমান আইন বা সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলেও জরুরি পরিস্থিতির সমাধানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি সংবিধানবহির্ভূত পদক্ষেপগুলির জন্য আইনগত ভিত্তি প্রদান করে, যা স্থিতিশীলতা এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখতে অপরিহার্য। এই প্রসঙ্গে, সুপ্রিম কোর্টের রায় অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতার জন্য একটি সাংবিধানিক ভিত্তি প্রদান করেছে।

গণভোটের প্রয়োজনীয়তা: গণতান্ত্রিক বৈধতা নিশ্চিতকরণ

এমনকি বৈধতার সম্ভাব্য পথগুলো থাকা সত্ত্বেও, অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তৃত্বকে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুদৃঢ় করা জরুরি। এর জন্য সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি হবে ১৯৯১ সালের গণভোট আইনের অধীনে একটি গণভোট আয়োজন। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুস ২৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে জাতির উদ্দেশ্যে বক্তব্যে বলেছেন, “নির্বাচনের সময় নির্ধারণ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের নয়। জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে কখন তারা আমাদের পদত্যাগ করতে চাইবে। আমরা ছাত্রদের আহ্বানে এসেছি, যারা আমাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। আমরা সবাইকে মনে করিয়ে দেব যাতে হঠাৎ করে আমাদের চলে যাওয়ার প্রশ্ন উত্থাপিত না হয়। আমরা তখনই যাব যখন তারা বলবে।”প্রফেসর ইউনুসের এই বক্তব্য নির্বাচনের সময় নির্ধারণে রাজনৈতিক ঐকমত্যের গুরুত্বকে তুলে ধরেছে। তিনি নিশ্চিত করেছেন যে, জনগণ যখন চাইবে তারা তাতেই পদত্যাগ করবেন।

জনগণের অভিপ্রায় বোঝার জন্য কোন সহজ পদ্ধতি নাই, তবে যদি সকল রাজনৈতিক দল ঐক্যমতে আসে তাহলে এটা একটা ইনডিকেটর হিসাবে কাজ করে যে জনগণ কোন সুদির্ষ্ট ব্যাপারে ঐক্যমত। তবে প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদেশ্য দেওয়া ভাষণের পর নির্বাচন এবং এই সরকারে সময়কাল নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতানক্য প্রকাশ্যে চলে এসেছে, তাই সংবিধান এবং গণতান্ত্রিক সমাজে, একটি সরকারের জনগণের সমর্থন পরিমাপের একমাত্র কার্যকর মাধ্যম হলো  গণভোট বা নির্বাচন। যেহেতু এই সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, একটি গণভোট তাদের কার্যক্রমের সমর্থন এবং ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ মাপার উপযুক্ত উপায় হতে পারে।

গণভোট নিম্নলিখিত মূল বিষয়গুলো পরিষ্কার করবে

প্রত্যক্ষ জনগণের ম্যান্ডেট: একটি রেফারেন্ডাম বা গণভোট জনগণকে সরাসরি তাদের মতামত প্রকাশ করার সুযোগ দিবে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা, মেয়াদ এবং নির্বাচনের সময় সম্পর্কে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে। অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তৃত্ব জনগণের মতামতের ভিত্তিতে স্থাপিত হবে, যা রাজনৈতিক নেতৃত্ব আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে পারবে না।

বৈধতা এবং স্বচ্ছতা: একটি  গণভোট অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্টিত করবে এবং জনগণ ও রাজনৈতিক অংশীদারদের মধ্যে বিস্তৃত গ্রহণযোগ্যতার পথ সহজতর করবে।

সংবিধানিক ফাঁক পূরণ: যেহেতু সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন সম্পর্কিত স্পষ্ট বিধান নেই, একটি  গণভোট এই ফাঁকটি পূরণের একটি স্থায়ী সমাধান প্রদান করবে। এটি জনগণের সম্মতি প্রতিফলিত করবে এবং সংবিধানে সরাসরি উল্লেখিত বিষয়গুলির সমস্যাগুলি সমাধান করবে।

শেষ কথা

যদিও বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য স্পষ্ট বিধান নেই, এর বৈধতা অনুচ্ছেদ ৭, সাংবিধানিক বিপ্লবের ধারণা এবং ডকট্রিন অব নেসেসিটি বা প্রয়োজনীয়তার নীতির মাধ্যমে যুক্তিসঙ্গত করা যায়। তবে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং ব্যাপক জনগণের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে অন্তর্বর্তী সরকার একটি গণভোটের মাধ্যমে বৈধতা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারে । এই প্রক্রিয়া নিশ্চিত করবে যে অন্তর্বর্তী সরকার একটি আইনগত এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে কাজ করবে, জনগণের উদ্বেগ সমাধান করবে এবং বাংলাদেশের সাংবিধানিক সুশৃঙ্খলা বজায় রাখবে এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময়ে।

এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া গ্রহণের মাধ্যমে, বাংলাদেশ তার বর্তমান রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে এবং জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হবে এবং এর সরকারে সময় কাল এবং কখন নির্বাচন হবে তা নির্ধারণ করিতে পারবে।

লেখক : ব্যারিস্টার মো. সালাহ উদ্দিন ভুইয়া। আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।