২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে। ফ্যাসিস্ট, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা প্রায় ১৫ বছরের অপশাসন শেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। এই ঘটনা দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে এক নতুন অধ্যায়ের দিকে নিয়ে গেছে। শেখ হাসিনার শাসন ,যা অনেকের কাছে ফ্যাসিবাদী হিসেবে চিহ্নিত, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
শেখ হাসিনার আমলে বিরোধী মতামতকে দমন করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল । রাজনৈতিক প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত নানা ধরনের দমনমূলক কৌশল অবলম্বন করে বাক স্বাধীনতা সম্পূর্নভাবে রহিত করে । বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা, গ্রেফতার এবং শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে মুক্ত চিন্তার , স্বাধীন রাজনীতির কোন স্থান তিনি রাখেনি। ২০১৪ ২০১৮, ২০২৪ সালের নির্বাচন পুর্বে ও পরবর্তী সময়ে বিএনপি ও জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। দমন পীড়নের মাধ্যমে নির্বাচনী বিতরণী অতিক্রম করে । বিশেষ করে, খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক কারণে হয়রানি করা হয়।তাঁকে অনেকটাই অবিচারের মাধ্যমে আটক করে রাখা হয়।
আমরা জানি যে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বয়কট করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য দল সমূহ , যার ফলে নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের নির্বাচন, যা ব্যাপকভাবে বিতর্কিত হয়েছিল, অনেকেই এটি ভোট কারচুপির একটি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মতে, নির্বাচনে ভোটের ফলাফল পূর্বনির্ধারিত ছিল এবং বিরোধী দলের প্রতিনিধিদের নির্বাচন কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বিরোধী দল ও সমর্থকদের ওপর সহিংসতা চালানোর অভিযোগও রয়েছে।২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ভুয়া নির্বাচনও একই রকম।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল আওয়ামী শাসন আমলে। সরকারের রাজনৈতিক প্রভাব বিচার ব্যবস্থার ওপর অসংগতভাবে বিস্তৃত হয়েছিল । বিভিন্ন মামলায় সরকারি হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছিল যা বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে যে, বিশেষ করে রাজনৈতিক মামলা এবং সরকারের বিরোধীদের বিরুদ্ধে বিচারাধীন মামলা পরিচালনায় পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে প্রতিনিয়ত।
মিডিয়ার স্বাধীনতা রক্ষায় যথেষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, হুমকি প্রদান, এবং সেন্সরশিপের মাধ্যমে মিডিয়ার স্বাধীনতা সীমিত করা হয়েছে। সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল যিনি সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করেছিলেন তাকে গুম করা হয়েছিলো। এমন শত শত অভিযোগ রয়েছে । গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরা হয়।
সরকারি প্রশাসনে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ আগেও ছিল তখন আরও বিস্তারিতভাবে প্রকাশ পায়। উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দে এবং অন্যান্য আর্থিক লেনদেনে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে। সরকারি বরাদ্দের অপ্রয়োগ ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে প্রকল্পগুলির বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতির শিকার হওয়ার ব্যাপারে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। যেখানে শেখ হাসিনার পরিবার সর্বগ্রাসী লুট লোপাটের সাথে যুক্ত বলে সংবাদে প্রকাশ পাচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য ও প্রকাশনার অভিযোগ উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঠিক প্রকাশ নিয়ে সরকারিভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মিথ্যাচার এবং সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশ করা হয়, যা জনগণের ইতিহাসের প্রতি অবিচার করেছে। ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে । নানা প্রকাশনায় উঠে এসেছে একটি দলের সৃজনশীল ইতিহাস।
নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নিয়মিতভাবে হরণ করা হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে দমনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল । বাক স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের অধিকার, এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকার সীমিত করা হয় । রাজনৈতিক প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে অত্যধিক পুলিশি দমন এবং হয়রানির ঘটনা অহরহ দেখা গেছে।
সরকারের সদিচ্ছার অভাব এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ফলে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়েছিল আওয়ামী দুঃশাসনে যা দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করেছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা অভিযোগ করেছে যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার বেড়ে গিয়েছিলো শেখ হাসিনার শাসন আমলে।
ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের প্রবণতা লক্ষণীয় ছিল। রাজনৈতিক ক্ষমতা এককভাবে পরিচালনা করা হয়েছে, যা একদলীয় শাসনের দিকে নিয়ে গেছে । সরকারিভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং বিরোধী মতের প্রতি মারমুখী মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিতেও ব্যর্থ হয়েছে।
শেখ হাসিনার শাসনের পতন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে একটি নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে। এই পতন নতুন নেতৃত্বের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। নতুন নেতৃত্বকে ফ্যাসিবাদী শাসনের অবশিষ্টাংশ মোকাবেলা করতে হবে এবং গণতন্ত্রের মূলনীতিগুলি পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি করতে হবে। গণতন্ত্রের পুনর্গঠন এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা অর্জনে নতুন নেতৃত্বের কার্যক্রম ও সিদ্ধান্তগুলি কতটা ফলপ্রসূ হবে তা ভবিষ্যতে স্পষ্ট হবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন একটি নতুন সূচনা এনে দিয়েছে। নতুন সরকারকে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটি মুক্ত ও স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে হবে। জনগণের আশা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণে নতুন নেতৃত্ব কতটা সফল হবে সেটিই এখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের মূল প্রশ্ন।
লেখকঃ কবি , গবেষক , রাজনৈতিক বিশ্লেষক
abuzubier4001@gmail.com