ঠিক করতে হবে রাষ্ট্রের ব্যাড সিস্টেম

লুৎফর রহমান হিমেল
29 August 2024 3:41 am
একমাত্র সিস্টেম সঠিকভাবে ফাংশন করলে অন্য শত শত সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।

একমাত্র রাষ্ট্রের সিস্টেম সঠিকভাবে ফাংশন করলে অন্য শত শত সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।

ছাত্ররা, তরুণরা দেশের কোটা সিস্টেম নিয়ে যে আন্দোলনটা করলো, যেটি কিনা শেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার আন্দোলনে রূপ নিল। আর অন্তিমে গিয়ে ঘটলো সরকারের দুঃশাসনের ইতি। আন্দোলনটা ছিল মূলত শেখ হাসিনার সরকার কর্তৃক সৃষ্ট দেশের ব্যাড সিস্টেমের বিরুদ্ধে। ওই ব্যাডসিস্টেমেরই একটি বাইপ্রোডাক্ট ছিল চাকরির কোটা। বিপ্লবী ছাত্র-জনতা এখন অন্তর্বর্তী একটি সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। সেই সরকার এখন দেশের এই ব্যাড সিস্টেম নিয়ে কথা বলা শুরু করেছে। এটি খুব ইতিবাচক একটি দিক বলে আমি মনে করি।

দেশের ব্যাড সিস্টেম নিয়ে গত এক দশক আগেও সেভাবে কেউ কথা বলেনি। সমালোচকদের বেশিরভাগই তখন মূলত বিচ্ছিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন। যেমন, দুর্নীতি, লুটপাট, সন্ত্রাস, নিয়োগবাণিজ্য ইত্যাদি। এগুলো পৃথক পৃথক ইস্যু। এসব সমাজ-রাষ্ট্রের ব্যাড সিস্টেমের ছোটখাট বাইপ্রোডাক্ট মাত্র। সমগ্র ব্যাড সিস্টেমের অংশবিশেষ। মূলত রাষ্ট্রসিস্টেম ঠিক করা গেলে আপনাআপনি অন্য সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে। যে কারণে আমি গুরুত্ব দিয়েছি দেশের টোটাল সিস্টেমটাকে। আমি পরিবর্তন ডটকমের যাত্রাই শুরু করেছিলাম এই ব্যাড সিস্টেমকে ‘পরিবর্তন’ করার টার্গেট নিয়ে।

সেই সময় তরুণদের অনেকে জানতে চাইতো, ব্যাড সিস্টেম বলতে আমি আসলে কী বুঝাতে চাই। আমি তখন একটি উদাহরণ দিতাম। বলতাম, একটি ভবন কল্পনা করো। সেই ভবনটি ঠিক নেই। এখন দেখতে হবে, ভবনটির কি কি নষ্ট হয়ে গেছে, সেগুলো ঠিক করতে হবে। যদি সব কিছুই নষ্ট হয়ে থাকে, ভবনটি ভেঙে ফেলতে হবে। তখন আর ভবনটিকে মেরামত করলে লাভ হবে না।

আমাদের রাষ্ট্রও একটি সিস্টেম। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এর যত্ন নেওয়া হয়নি। রাষ্ট্র নামক এই ভবনের ইট নষ্ট হয়ে গেছে, রড নষ্ট হয়ে গেছে, দেয়ালের সিমেন্ট-চুন-সুড়কি নষ্ট হয়ে গেছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র নামের সিস্টেমটি নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট করা হয়েছে। কী করবে তোমরা? হ্যাঁ, ঠিকই ভেবেছ। ভেঙে ফেলতে হবে ভবনটি। নতুন করে সেখানে ভবন বানাতে হবে। এর মানে এই নয় যে, দেশকে ভেঙে অন্য দেশ বানাতে হবে।

আমি প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ফার্মগেটের ফুটপাত দিয়ে হাঁটাহাঁটি করি। এখান দিয়ে যাওয়ার সময় ফুটপাত দিয়ে হাঁটা যেতো না। এখনো হাঁটা যায় না। আমি বিভিন্ন সরকারের পরিবর্তন দেখি। কিন্তু ফুটপাতের দোকান ও দোকানির কারোরই বদল দেখি না। শুধু পরিবর্তন ঘটে সেই চাঁদাবাজদের যারা এসব দোকানদারদের কাছ থেকে টাকা উঠায়। এক চাঁদাবাজ যায়, অন্যরা আসে। এখানে ফুটপাতে ব্যবসার সিস্টেমটি রয়েই যায়। এই সিস্টেমকে ঘিরে নানা অপরাধও ঘটে। খুনোখুনি, হামলা, অপহরণ বহুবিধ ঘটনা। এখান থেকে টাকার একটি অংশ পুলিশে, নেতায়, মন্ত্রীতেসহ নানা জায়গায় ভাগ হয়ে যায়। এই সিস্টেম তুলে দিলে ফুটপাত মুক্ত হতো, অপরাধ বন্ধ হতো, লোকে সহজে যাতায়াত করতে পারতো। এটিই চায় জনগণ। অর্থাৎ, একটা ব্যাড সিস্টেম বন্ধ করলে অন্য দশটা সমস্যার সমাধান হয়ে যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে।

কিন্তু বাস্তবে সরকার পরিবর্তনে ব্যাড সিস্টেমটা যায় না, সমস্যাগুলোরও সমাধান হয় না।

ব্যাড সিস্টেম সমাজে বসবাসকারী মানুষদের মনোজগতেরও বিপুল ক্ষতি করে। যেমন, আমাদের সমাজে ধর্ষণের শিকার মেয়েটির অপরাধ না থাকলেও তাকে সবাই প্রত্যাখ্যান করে। ধর্ষক প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ধর্ষকের বাবা-মা কিংবা স্বজনদের মধ্যে কোনো সংকোচ বা লজ্জাবোধ দেখা যায় না। উপরন্তু ধর্ষকের মর্দামি নিয়ে গর্ব করতেও দেখা যায় অনেককে। কিছু লোক ধর্ষণের শিকার মেয়ের পোশাক নিয়ে প্রশ্নও তোলে।

যার টাকা-পয়সা বেশি তাকে বেশি কদর করে সমাজ! অথচ হবার কথা ছিল জ্ঞানীর কদর। শিক্ষিত ব্যক্তির কদর। মানুষের এরকম প্রতিবন্দি মানসিকতার কারণে সমাজ পিছিয়ে পড়ে।

এরকম বহু নেগেটিভ ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকে ব্যাড সিস্টেম রাষ্ট্রসমাজে।

বাংলাদেশ নামের দেশটি জন্মের পর থেকে লুটেরা, লম্পট, দুর্নীতিবাজেরা চালাচ্ছে। আমাদের দেশটি সম্ভাবনাময় হলেও এই ব্যাড সিস্টেমের কারণে দিনে দিনে পিছিয়ে পড়েছে। এখানে গড়ে উঠেনি সঠিক রাজনৈতিক চর্চা। বিভেদের রাজনীতি আমাদেরকে হানাহানিতে ঠেলে দেয় বারবার। দুর্নীতি হয়ে উঠেছে নিত্যসঙ্গী। অনিয়ম হয়ে গেছে অভ্যাস। নিয়মকে তাই আমরা ভয় পাই। বা নিয়মের কথা তুললে তার দিকে তেড়ে যাই লাঠি নিয়ে। এসব থেকে পরিত্রাণ চায় সবাই। কিন্তু কীভাবে, জানে না কেউ।

এই ত্রাহি অবস্থা থেকে ‘পরিবর্তন চাই, পরিত্রাণ চাই’ বলে মনে একটি হাহাকার বাজতো সবসময়। পরিবর্তন নিউজ পোর্টালটির নামকরণও সেখান থেকে মনে আসা। পরিবর্তন যখন বের করি, সেই থেকে ধারাবাহিকভাবে অনেকগুলো কলাম লিখে ফেলি সেই সময় (২০১২ থেকে ২০১৫ অবধি)। ‘রানা প্লাজার মুর্দার সাথে কথোপকথন’ তারমধ্যে একটি। শিরোনামটি লিখে গুগলে সার্চ দিলে এখনো হয়তো লেখাটি মিলবে। তুমুল পাঠকপ্রিয় স্যাটায়ার নাট্যধর্মী ওই লেখায় সাভারের স্থানীয় এমপি, ভূমি অফিস, প্রশাসন, পুলিশ, নেতাকর্মী কাউকেই ছাড় দেইনি। রানাপ্লাজা স্রেফ একটি ভবন নয়, এটি বৃহৎ একটি ব্যাড সিস্টেমের ভেতরের ছোট আরেকটি ব্যাড সিস্টেম। যা ভেঙে পড়েছিল নিরীহ গার্মেন্টস শ্রমিকদের ওপর। শ্রমিকরা নিরপরাধ ছিল। ব্যাড সিস্টেমের কারিগররা কিন্তু সেদিন ভবনচাপা পড়ে মারা যায়নি।

আমরা যখন সমাজের খুনখারাবি নিয়ে লিখি, চাঁদাবাজি নিয়ে লিখি, সন্ত্রাস নিয়ে, অনিয়ম নিয়ে লিখি; সেটি ব্যাড সিস্টেমের বাইপ্রোডাক্ট মাত্র। আমাদের লিখতে হবে সমাজের যে ব্যাড সিস্টেমটি গেড়ে বসেছে সেই সামগ্রিক সিস্টেমটির কথা। সেই সিস্টেম ভেঙে দেওয়া বা গুড়িয়ে দেওয়ার কথা বারবার লিখতে হবে। ব্যথা সারানোর জন্য মলম দিলে হয়তো ক্ষণিকের উপশম মিলবে, কিন্তু কী কারণে ব্যথাটা হচ্ছে সেটি সনাক্ত করে না সারালে ব্যথা বারবার ফিরে আসবেই। যেমনটা সরকার বদলেও ফুটপাতের ব্যবসাটা ফিরে ফিরে আসছেই।

সিস্টেম ঠিক করা গেলে মেধার মূল্যায়নটা হবে অটোমেটিক। কারো তদবির লাগবে না। কোটা সিস্টেম ভেসে যাবে। যোগ্যরা মূল্যায়িত হবে এবং দেশ ও সমাজও আগাবে। একমাত্র সিস্টেম সঠিকভাবে ফাংশন করলে অন্য শত শত সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হলে সমাজরাষ্ট্রের মানুষের মনোজগতেরও ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে। তখন ধর্ম, রাজনীতি, গোত্র, বর্ণ, পরিচয় ছাপিয়ে জ্ঞান ও মেধাই হয়ে উঠবে ব্যক্তির যোগ্যতার মাপকাঠি। ছাত্ররা আজ রাষ্ট্রসিস্টেমটাকে ঠিক করার লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছে। ওদের জন্য শুভ কামনা।

লেখক : সম্পাদক, প্রিয়দেশ