আওয়ামী লীগে কাউয়া আছে, কিন্তু কাকতাড়ুয়া কই?

লুৎফর রহমান হিমেল
2 July 2024 2:47 am
আওয়ামী লীগে এখন সুসময়, তাই শুভাকাঙ্খীও বেশি

টানা তিন মেয়াদে এখন ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। ছবি : সংগৃহীত

লুৎফর রহমান হিমেল

আওয়ামী লীগে সুসময় চলছে। দেশের ঐতিহ্যবাহী এই রাজনৈতিক দলটি টানা তিন মেয়াদে এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। ক্ষমতা মানেই সুদিন, আর সুদিন মানেই দলে শুভাকাঙ্খীদের ভিড়। আওয়ামী লীগের নৌকাতেও এখন শুভাকাঙ্খীদের ভিড়ে স্বাভাবিকভাবে নড়াচড়া করার জো নেই। নেতাকর্মীর সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। ফলে নৌকাতে গা ঠাসাঠাসি অবস্থা এখন। যারা পুরানা, তারা অনেকটাই নৌকার গুলুইয়ের দিকে কোনঠাসা। যারা নতুন শুভাকাঙ্খি, তাদের অবস্থানটা নৌকার মধ্যখানে একেবারে ভাল ভাল জায়গায়।

হঠাৎ গজিয়ে উঠা শুভাকাঙ্খীদের ভিড়টা এতোই বেশি যে, সুবিশাল নৌকায় এখন ”ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই” অবস্থা। ফলে মাঝেসাঝেই ডুবোডুবো হয়ে যায় নৌকা। তখনই নৌকার মাঝিমাল্লারা দু-একবার সতর্কতার হাঁক ছাড়েন। এই যেমন কিছুদিন আগে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বললেন, ‘প্রচার লীগ, তরুণ লীগ, কর্মজীবী লীগ, ডিজিটাল লীগ, হাইব্রিড লীগ আছে। কথা হাছা, সংগঠনে কাউয়া ঢুকছে। জায়গায় জায়গায় কাউয়া আছে। পেশাহীন পেশিজীবী দরকার নেই। ঘরের ভেতর ঘর বানানো চলবে না। মশারির ভেতর মশারি টানানো চলবে না।’

এই ”কাউয়া তত্ত্বের” পর তিনি আবার বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগে ফার্মের মুরগি ঢুকেছে। ফার্মের মুরগির কারণে দেশি মুরগি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। দেশি মুরগি দরকার, ফার্মের মুরগি নয়। ফার্মের মুরগি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। চারদিকে আতি নেতা, পাতি নেতায় ভরে গেছে। তবে আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে অপকর্ম করা চলবে না। তাহলে কাউকে ক্ষমা করা হবে না। দেশ বাঁচাতে হলে, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে হবে।’

বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ঋতু যেভাবে বদলায়, আমাদের রাজনীতির মৌসুমও সেভাবে বদলায়। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হল, যে-ই দলই ক্ষমতায় আসে, সুদিনের আবহাওয়ায় মৌসুমী অতিথি পাখিদের মতো এরা অন্য দল থেকে এসে ভিড় করে। ক্ষমতা চলে যায়, এই অতিথি পাখিরাও উড়ে চলে যায় সুবিধাজনক দলে। শুধু থেকে যায় নিরীহ ত্যাগিরা।

আওয়ামী লীগের নৌকায়ও এখন এই অতিথিদের সর্বকালের আনন্দ কলরব-কল্লোল চলছে। এ কলরব সারাবেলা, সারাবছর জুরেই চলছে। ওবায়দুল কাদের সেদিকেই হয়তো ইঙ্গিত করেছেন। তিনি কাঠখোট্টা ভাষায় এই অতিথিদের ”কাউয়া” এবং ”ফার্মের মুরগি” বলে ডেকেছেন। খুবই ভাল পর্যবেক্ষণ।

মন্ত্রী তাদের কাউয়া-ফার্মের মুরগি ডেকেছেন, সবই ঠিক আছে। কিন্তু তিনি কাউয়া তাড়ানোর উপায় বা কাকতাড়ুয়ার কোনো সন্ধান বাতলে দেননি। কারা কাউয়াদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়, সেটাও খুলে বলেননি। অথচ কাউয়া সনাক্ত করার চেয়ে কাউয়া তাড়ানোর কাজটা এ মূহুর্তে বেশি দরকার। এ দেশে ভুক্তভোগি মানুষরা তাদের সমস্যাকে এতো প্রকটভাবে মোকাবিলা করেন যে, তাদেরকে আর সমস্যার কাউয়াদেরকে চিহ্নিত করে দিতে হয় না। কোনো গবেষণারও দরকার পড়ে না। তাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনার দরকার নেই, দরকার শুধু সমাধান নিয়ে আলোচনার। কাউয়া বা ফার্মের মুরগি যে দলে আছে, এটা ষোলো কোটি মানুষের সবাই জানে। কিন্তু কাউয়া থেকে তাদের উদ্ধারে সেই কাকতাড়ুয়ার সন্ধান তারা কোনোদিন পান না।

কাকতাড়ুয়া আমাদের গ্রামীণ জীবনে বড় উপকারি এক জিনিস। এর ইংরেজি শব্দ হল স্কেয়ারক্রাও (Scarecrow)। কাক কিংবা অন্যান্য পশু-পাখিকে ভয় দেখানোর জন্যে জমিতে ফসল রক্ষায় মানুষের প্রতিকৃতির ওপরে যে শার্ট বা টিশার্ট পরানো কাঠামোটা দেখি, তা’ই কাকতাড়ুয়া। ফসল রক্ষায় এই কাকতাড়ুয়ার যাদুকরি ক্ষমতার কথা কে না জানে?

এখন সরকারি দলে এই কাউয়াদের তাড়াতে কাকতাড়ুয়ার বেশি প্রয়োজন। এটা যেমন ক্ষমতাসীন দলটির জন্য দরকার; তেমনি দেশবাসীরও মনের দাবি। কারণ, এই কাউয়াদের দাপটেই তারা আজ অসহায়। এরা সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুরু করে গ্রাম-মহল্লার মসজিদ কমিটিতেও সগৌরবে আসীন। তারা হেন আকাম-কুকাম নেই যে করছে না। জনগণ একেবারে তিষ্ট-অতিষ্ট।

এই সমস্যার সমাধান জরুরি। আর এই সমাধান তো শুধু কথা বলে হবে না। কথায় আছে, লাথির ঢেকি চড়ে ওঠে না। তেমনি শুধু কথায় কাজ হবে না। করে দেখাতে হবে। দলের একজন শীর্ষপদধারী নেতা হিসেবে শুধু সমস্যার কর্মবাচ্যে বা ভাববাচ্যে ”ব্যবস্থা নেওয়া হবে”, বা ”ক্ষমা করা হবে না” ধরণের বক্তৃতায় সীমাবদ্ধ থাকলে কাজের কাজ হবে না। আপনার মুখ থেকে ”ব্যবস্থা নেব,” বা ”ক্ষমা করব না” গোছের কর্তৃবাচ্যে ডাইরেক্ট অ্যাকশন দেখতে চায় ভুক্তভোগী জনগণ। এতে আপনার দল যেমন রক্ষা পাবে, দেশবাসীও স্বস্তি পাব।

লেখক: সম্পাদক, প্রিয়দেশ