প্রবীন রাজনীতিবিদ, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান, ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বঙ্গবন্ধুর সহচর, সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের মেধাবী ছাত্র, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বারের সদস্য, বাংলাদেশের অন্যতম সংবিধান প্রণেতা, বর্ণাঢ্য রাজনীতিক, সাবেক মন্ত্রী, ভাটিবাংলার সিংহ পুরুষ— এ রকম অনেক নামেই তাকে ডাকা যায়। ২০১৭ সালে নতুন করে একটি অভিধা যোগ হয় তার নামের আগে। আর নিদারুন সেই অভিধাটি হল ”প্রয়াত।” ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারির পর থেকে তাঁকে ডাকা হয় ”প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত” নামে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার এক রাজনীতিকের নাম সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (৫ মে ১৯৪৫ – ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)। নিজের ললাটে সংস্কারপন্থী তকমাটা সেঁটে যাবার পর থেকেই যে ষড়যন্ত্রের পাকেচক্রে পড়া শুরু, যেটার সমাপ্তি ঘটে তাঁর এপিএস ফারুকের কথিত ”টাকার বস্তা” নাটকে। তাই নামের মতোই সেনগুপ্ত বাবু গুপ্ত ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে এক ট্রাজিক হিরো হিসেবে আবির্ভূত হন রাজনৈতিক জীবনের শেষদিনগুলোতে।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের সংস্কৃতি হলো, আপনি দলের শীর্ষ নেতা, তাহলে আপনার সন্তানরাই দলের নেতৃত্বে আসবে। আপনি যেহেতু দলের শীর্ষ নেতা, আপনার দখলেই থাকবে সর্বময় ক্ষমতা। অথচ এটি গণতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ অবস্থা প্রতিটি দলেই বিরাজিত। নতুনকে বরণ করে নেবার মানসিকতা নেই কারোরই। এমন অবস্থায় সুযোগ পেয়ে দলের সংস্কারের প্রশ্নে কথা বলে উঠেছিলেন কয়েকজন বর্ষিয়ান রাজনীতিক। তাদের মধ্যে এই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও ছিলেন। বহুল কাঙ্খিত সেই সংস্কার উদ্যোগ ভেস্তে গেলেও সেই মতবাদের সমর্থক হবার কারণে তাকে তোষামোদির ধারার রাজনীতিতে শেষ জীবনে একেবারে কোনঠাসা করে দিয়েছিল। তারপরও তিনি থেমে থাকেননি। নিজের দলেরই হোক কিংবা বিরোধী কোনো দলেরই অন্যায় হোক, তিনি সমালোচনা করে গেছেন সংসদে, সংসদের বাইরেও।
দেশের রাজনীতিতে বিশেষ করে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধারার বাংলাদেশে তার অবদান হিসেব করলে শেষ বিদায়টা আরো উজ্জ্বলতর হতে পারতো। কিন্তু দিরাইয়ের দিলদরিয়া এই নেতার রাজনৈতিক চরিত্রে কালিমার তিলকরেখা সেটি হতে দেয়নি। যদিও সেই ‘টাকার বস্তা’ খ্যাত কাঁচা নাটকটি পরে অনেকেই বুঝতে পেরেছিলেন। কারণ এ যুগে কেউ ৭০ লাখ টাকা এভাবে বস্তায় ভরে ”উপহার” নেয় না। টাকার বস্তা জিগাতলা নাকি মোহাম্মদপুর সেটি পরিস্কার হয়ে যায় এরপরই। এর নেপথ্যে যে শেয়ার লুটেরাদের কারসাজি আর সংস্কারপন্থী হবার ”পাপ” ছিল, সেটা এতোদিনে বুঝে নিয়েছেন আমজনতা।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বঙ্গবন্ধুর সহচর এমন একজন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের চলে যাওয়া তাই বড় এক শূণ্যতারই আবাহন। বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি বড় অধ্যায়ের সমাপ্তিও বটে। আর সেই সমাপ্তির বিউগলের করুন সুর জাতিকে বহুদিন মনে করিয়ে দেবে ভাটিবাংলায় এক সিংহপুরুষ নামের একজন ছিলেন। যিনি তৃণমূল মানুষের অধিকার নিয়ে সংসদের ভেতরে-বাইরে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। কখনো তার কণ্ঠ হাওরপাড়ের পল্লীর দরিদ্র জেলেদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হতো, কখনোবা শহুরে মধ্যবিত্তের লুট হয়ে যাওয়া শেয়ারবাজারের হোতাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতো।
প্রচল রাজনৈতিক সংস্কৃতির উল্টো স্রোতে সাঁতার কেটে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলার মানুষ এমনিতেই কমে গেছে। বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের প্রস্থানে সেই জায়গাটা আরো শূণ্য হয়েছে।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, প্রিয়দেশ