৫ই আগস্ট ২০২৪ ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থাণে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়েন বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। এরইমধ্যে অতিবাহিত হয়ে গেছে ১০০ দিন। ভারতের ঠিক কোথায় এবং কীভাবে আছেন ক্ষমতাচ্যূত এই শাসক? অনেকেরই কৌতূহল এই প্রশ্নটিকে ঘিরে।
ভারতের রাজধানী দিল্লির কেন্দ্রস্থলকে চক্রাকারে ঘিরে রয়েছে যে ইনার রিং রোড, তার ঠিক ওপরেই চারতলা পেল্লায় বাড়িটা। ডাক বিভাগের রেকর্ড অনুযায়ী ঠিকানা ৫৬ রিং রোড, লাজপত নগর, দিল্লি ১১০০২৪।
শহরের দক্ষিণপ্রান্তে পাঞ্জাবি অধ্যুষিত ওই এলাকায় এই বাড়িটার আলাদা করে কোনও বিশেষত্ব চোখে পড়ার কোনও কারণ নেই! কিন্তু আসলে ক’জনই বা জানেন প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে শেখ হাসিনা যখন প্রথম ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তার ঠিকানা ছিল রিং রোডের ওপরে এই ভবনটাই?
আসলে তখন ৫৬ রিং রোড ছিল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের একটি ‘সেফ হাউজ’ বা গোপন অতিথিশালা। শেখ মুজিব আততায়ীদের হাতে নিহত হওয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যখন তার কন্যাকে সপরিবার ভারতে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রথমে তার থাকার ব্যবস্থা করেছিল এই বাড়িটিতেই।
পরে একাধিকবার হাতবদল হয়ে ওই ভবনটি এখন শহরের একটি ছিমছাম চারতারা হোটেলে রূপ নিয়েছে। নাম ‘হোটেল ডিপ্লোম্যাট রেসিডেন্সি’।
কিন্তু বাংলাদেশের এই মেডিক্যাল ট্যুরিস্টদের যারা ওই বিশেষ হোটেলটিতে ওঠেন, তাদের হযতো কারওরই জানা নেই তাদের দেশের সবচেয়ে বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী থাকা শেখ হাসিনাও তার জীবনের চরম সঙ্কটের মুহূর্তে ওই একই ভবনে আশ্রয় পেয়েছিলেন!
ছবির ক্যাপশান,দিল্লির লাজপতনগরে ৫৬ রিং রোডের ভবনটি, এখন যেভাবে। ছবি : Hotel Diplomat
লাজপত নগরের ওই ঠিকানায় অবশ্য শেখ হাসিনা বা তার পরিবারকে খুব বেশিদিন থাকতে হয়নি।
শহরের ব্যস্ততম রাস্তার ওপর একজন গুরুত্বপূর্ণ অতিথিকে দীর্ঘ সময় রাখাটা নিরাপদ নয় বিধায় তাদের সরিয়ে নেওয়া হয় দিল্লির কেন্দ্রস্থলে অভিজাত পান্ডারা রোডের একটি সরকারি ফ্ল্যাটে, যার বাইরে ঝোলানো থাকত ভিন্ন নামের নেমপ্লেট। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর সেখানেই ছিলেন তারা।
লাজপত নগরের সেই ভবনে এসে ওঠার ঠিক ৪৯ বছর বাদে বাংলাদেশ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা যখন আরও একবার ভারতে এসে আশ্রয় নিলেন – তখনও কিন্তু শহরে তার প্রথম ঠিকানায় তিনি থিতু হননি।
আসলে আজ থেকে ঠিক একশো দিন আগে অগাস্টের ৫ তারিখে চরম নাটকীয় পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা যখন ভারতে পা রাখেন, দিল্লির বিশ্বাস ছিল তার এই আসাটা একেবারেই সাময়িক – ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনও দেশে যাওয়ার আগে এটা একটা সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতির বেশি কিছু নয়!
যে কোনও মুহূর্তে তৃতীয় কেনও দেশের উদ্দেশে তিনি রওনা হয়ে যাবেন, এই ধারণা থেকেই প্রথম দু-চারদিন তাকে (ও সঙ্গে বোন শেখ রেহানাকে) রাখা হয়েছিল দিল্লির উপকন্ঠে গাজিয়াবাদের হিন্ডন বিমানঘাঁটির টার্মিনাল বিল্ডিং-এই, যেটির নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার ভার দেশের বিমান বাহিনীর।
কিন্তু চট করে শেখ হাসিনার তৃতীয় কোনও দেশে পাড়ি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠার পর ভারত সরকার তাকে হিন্ডন থেকে সরিয়ে আনে দিল্লির কোনও গোপন ঠিকানায়। পরে তাকে হয়তো দিল্লির কাছাকাছি অন্য কোনও সুরক্ষিত ডেরাতে সরিয়েও নেওয়া হয়েছে – কিন্তু এ ব্যাপারে ভারত সরকার আজ পর্যন্ত কোনও তথ্যই প্রকাশ করেনি।
কিন্তু ‘লোকেশন’ যা-ই হোক, ভারতে তার পদার্পণের একশো দিনের মাথায় এসে এই প্রশ্নটা ওঠা খুব স্বাভাবিক যে এখন শেখ হাসিনাকে কীভাবে ও কী ধরনের নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে? আর সেটার পেছনে কারণটাই বা কী?
দিল্লির কাছে ভারতের বিমানবাহিনীর হিন্ডন এয়ারবেসের মূল প্রবেশপথ। IAF
পাশাপাশি এই ‘এক্সট্রাঅর্ডিনারি সিচুয়েশন’ বা চরম অস্বাভাবিক একটা পরিস্থিতিতে তিনি স্বাধীনভাবে কতটা কী করতে পারছেন? কিংবা ‘হোস্ট কান্ট্রি’ হিসেবে ভারত কি তাকে কোনও কোনও কাজ না-করারও অনুরোধ জানিয়েছে?
দিল্লিতে একাধিক মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা ও ওয়াকিবহাল মহলের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বিবিসি বাংলা এই সব প্রশ্নের যে উত্তর পেয়েছে, এই প্রতিবেদনে থাকছে তারই সারাংশ।
সরকারি পদমর্যাদা ও নিরাপত্তাগত ঝুঁকি বিবেচনায় ভারতের ভিভিআইপি-রা বিভিন্ন ক্যাটেগরির নিরাপত্তা পেয়ে থাকেন– যার মধ্যে ‘জেড প্লাস প্লাস’-কেই সর্বোচ্চ বলে ধরা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা অবশ্য সম্পূর্ণ আলাদা মানদণ্ডে আয়োজন করা হয়, ‘স্পেশাল প্রোটেকশন গ্রুপ’ বা এসপিজি কমান্ডোরা সচরাচর বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় রেখে তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সামলান।
যে ভিভিআইপি-দের নিয়মিত প্রকাশ্যে আসতে হয়, আর যাদের লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকলেও চলে– অবশ্যই তাদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার আয়োজনও হয় কিছুটা ভিন্ন ধাঁচের।
তাহলে ‘অপ্রত্যাশিত অথচ অতি গুরুত্বপূর্ণ’ অতিথি শেখ হাসিনার জন্য ভারত এখন ঠিক কোন ধরনের নিরাপত্তা প্রোটোকল অনুসরণ করছে?
হুবহু এই প্রশ্নটাই করেছিলাম ভারতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাকে, যিনি গত একশোদিন ধরে ভারতে শেখ হাসিনার প্রতিটি পদক্ষেপের বিষয়ে সম্পূর্ণ অবগত।
ছবির ক্যাপশান,ভারতের এলিট এসপিজি কমান্ডোদের একটি দল (ফাইল ছবি)। Getty Images
ক্ষুদে বার্তায় তিনি ছোট ছোট তিনটে বাক্যে এই প্রশ্নের যে উত্তর দিলেন, তা এরকম :
এক. “বেয়ার মিনিমাম, প্লেইন ক্লোদস, নো প্যারাফারনেলিয়া!”
যার অর্থ হল, যেটুকু না-হলে নয় শেখ হাসিনাকে সেটুকু নিরাপত্তাই দেওয়া হয়েছে, সাদা পোশাকের রক্ষীরাই তার চারপাশে ঘিরে রয়েছেন (জলপাই-রঙা উর্দির কমান্ডো বা সেনা সদস্যরা নন), আর গোটা বিষয়টার মধ্যে কোনও আতিশয্যর বালাই রাখা হয়নি! মানে ঢাকঢোল পিটিয়ে বা ঘটা করে তাকে কোনও নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে না, বরং পুরো জিনিসটাকে খুব নিচু তারে বেঁধে রাখা হয়েছে।
দুই. ‘ইন হার কেস, সিক্রেসি ইজ দ্য সিকিওরিটি!”
সোজা কথায়, তার বেলায় গোপনীয়তাই হল নিরাপত্তা! এটারও অর্থ খুব সহজ– শেখ হাসিনার অবস্থানের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে গোপনীয়তা রক্ষার ওপর, কারণ তিনি কোথায়, কীভাবে আছেন এটা যত গোপন রাখা সম্ভব হবে, ততই তার নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করা সহজ হবে।
তিন. “মুভমেন্টস অ্যান্ড ভিজিটস– অ্যাজ লিটল অ্যাজ পসিবল!”
ফলে ওই কর্মকর্তা তার তৃতীয় বাক্যে জানাচ্ছেন, শেখ হাসিনাকে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া, কিংবা তার সঙ্গে অন্যদের দেখা করানোর ব্যবস্থা– এটাও যতটা সম্ভব এড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে শেখ হাসিনার মুভমেন্টস বা ভিজিটস যে পুরোপুরি বন্ধ নয়, তার কথায় সে ইঙ্গিতও ছিল!
ওই কর্মকর্তার কথা থেকে স্পষ্ট, শেখ হাসিনার জন্য কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকলেও সেটা খুব বিশেষ এক ধরনের আয়োজন– মানে ধরা যেতে পারে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্য যে ধরনের নিরাপত্তা থাকে তার সঙ্গে সেটা মাত্রায় তুলনীয় হলেও আয়োজনে একেবারেই অন্য রকম!
ছবির ক্যাপশান,১৯৭৫-৮১ পর্বে দিল্লি থাকাকালীন এই নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায় প্রায়ই আসতেন শেখ হাসিনা। Getty Images
শেখ হাসিনাকে যাতে কোনওভাবেই প্রকাশ্যে না-আসতে হয়, এই প্রোটোকলে সেই চেষ্টাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
ফলে দিল্লির মর্নিং ওয়াকারদের স্বর্গ লোদি গার্ডেনে তিনি এসে মাঝেমাঝে হাঁটাহাঁটি করে যাচ্ছেন কিংবা ইচ্ছে করলে নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায় বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যায় কাওয়ালি শুনে আসছেন– এই ধরনের যাবতীয় জল্পনা হেসেই উড়িয়ে দিচ্ছেন ভারতের সংশ্লিষ্ট মহলের কর্মকর্তারা!
সেই সঙ্গেই তারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দিয়েছে, এর অর্থ হলো তার সম্পূর্ণ নিরাপত্তা ও সুরক্ষার দায়িত্বও কিন্তু এখন ভারতেরই কাঁধে। সেখানে সামান্য কোনও ভুলচুক হলেও তার দায় ভারতের কাঁধেই আসবে এবং সেটা দিল্লির জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর হবে।
ফলে সেই নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনও আপস করা যাবে না এবং তার জীবনকে সামান্যতম ঝুঁকিতেও ফেলা যাবে না; আর পাশাপাশি পুরো বিষয়টা অত্যন্ত গোপন রাখতে হবে– এগুলো বিবেচনায় নিয়েই সাজানো হয়েছে তার নিরাপত্তা প্রোটোকল!
ঘনিষ্ঠজনদের সাথে মেলামেশা?
গত ৫ অগাস্ট যখন শেখ হাসিনা দিল্লিতে এসে নামলেন, সে দিনই সন্ধ্যায় দিল্লিতে কংগ্রেসের একদা মুখপাত্র শর্মিষ্ঠা মুখার্জি নিজের এক্স হ্যান্ডল থেকে একটি টুইট করেন।
তাতে তিনি লেখেন, “স্টে সেফ অ্যান্ড স্ট্রং, হাসিনা আন্টি। টুমরো ইজ অ্যানাদার ডে, মাই প্রেয়ার্স আর উইথ ইউ!”
শেখ হাসিনাকে ‘আন্টি’ বলে ডাকতে পারেন, দিল্লিতে শর্মিষ্ঠা মুখার্জি ছাড়া এমন আর দ্বিতীয় কেউ আছেন কি না বলা খুব মুশকিল! সেই প্রিয় আন্টিকে মনোবল শক্ত রাখার কথা বলতে তিনি কিন্তু এক মুহূর্ত দেরিও করেননি।
৫ই অগাস্ট শর্মিষ্ঠা মুখার্জির করা টুইটের স্ক্রিনশট। Sharmistha Mukherjee/X
আসলে শর্মিষ্ঠা মুখার্জির আর একটা পরিচয় হলো, তিনি ভারতের প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কন্যা। খুব ছোটবেলায় শেখ হাসিনার পরিবারের সঙ্গে তার যে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল, তা আজও এতটুকু ম্লান হয়নি বলেই তিনি ওই কথাগুলো সেদিন বলতে পেরেছিলেন।
পঁচাত্তরে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শেখ হাসিনাকে দিল্লিতে আশ্রয় দেওয়ার পর তাদের ‘স্থানীয় অভিভাবক’ হিসেবে সবকিছু দেখাশুনোর ভার ছেড়ে দিয়েছিলেন তার আস্থাভাজন বাঙালি কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখার্জির ওপর। হিন্দি ও পাঞ্জাবিভাষীদের শহর দিল্লিতে নির্ভেজাল বাংলায় কথা বলতে পারাটাও তখন শেখ হাসিনা ও তার স্বামী-সন্তানদের জন্য ছিল বিরাট একটা ব্যাপার!
প্রণববাবুর স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জির সঙ্গেও নিবিড় পারিবারিক বন্ধন গড়ে উঠেছিল শেখ হাসিনার। আর শেখ হাসিনার মেয়ে পুতুল ও প্রণববাবুর কন্যা শর্মিষ্ঠা ছিল প্রায় সমবয়সী, দুটি বাচ্চা মেয়ে প্রায়ই পান্ডারা রোড থেকে হাঁটাপথের দূরত্বে ইন্ডিয়া গেটের প্রশস্ত লনে খেলতে চলে যেত!
প্রণববাবু নিজে একবার এই প্রতিবেদককে হাসতে হাসতে গল্পচ্ছলে বলেছিলেন, “নিজের ছেলেমেয়েদের কখনও সেভাবে সময় দিতে পারিনি, কিন্তু মিসেস গান্ধীর নির্দেশে আমি শেখ হাসিনার ছেলে-মেয়ে, জয় আর পুতুলকে নিয়ে হরিয়ানার দমদমা লেকে বোটিং পর্যন্ত করিয়েছি!”
ফলে প্রণব মুখার্জির গোটা পরিবারের সঙ্গে শেখ হাসিনার পরিবারের সবার কেন নিবিড় আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল, তা বোঝা মোটেই শক্ত নয়।
২০১০ সালে ভারতের তখনকার অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। Getty Images
প্রয়াত পিতাকে নিয়ে শর্মিষ্ঠা মুখার্জি গত বছর ‘প্রণব মাই ফাদার’ নামে যে স্মৃতিচারণাটি লিখেছেন তাতেও তিনি লিখেছেন, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীনও দিল্লিতে হুটহাট প্রণববাবুর কাছে তার ফোন আসত!
প্রণব মুখার্জি হয়তো তখন দেশের অর্থ, প্রতিরক্ষা বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তিনি শেখ হাসিনাকে মনে করিয়ে দিতেন এভাবে একজন প্রধানমন্ত্রীর অন্য দেশের ক্যাবিনেট মন্ত্রীকে সরাসরি ফোন করাটা ঠিক বিধিসম্মত নয়!
শর্মিষ্ঠা মুখার্জি জানাচ্ছেন, তখনই হাসিনা তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলে উঠতেন, “আরে রাখেন তো আপনার প্রোটোকল! শোনেন, যে জন্য ফোন করলাম…”
ওপরের এতগুলো কথা এই জন্যই বলা, যে দিল্লিতেও এমন কেউ কেউ আছেন রাজনীতি বা কূটনীতির ঊর্ধ্বে উঠে শেখ হাসিনা যাদের ‘ফ্যামিলি’ বলে ভরসা করতে পারেন।
দিল্লিতে সে সময় বহুদিন থাকার সুবাদে তার নিজস্ব পরিচিতিরও একটা বলয় গড়ে উঠেছিল, যাদের মধ্যে কেউ কেউ এখনও জীবিত বা সক্রিয় আছেন।
কিংবা দিল্লিতে আজও আছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক কর্নেল অশোক তারা-র মতো কেউ, যিনি একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর সকালে ধানমন্ডিতে পাকিস্তানি সেনাদের পাহারায় থাকা শেখ হাসিনা-সহ মুজিব পরিবারের সদস্যদের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। আজও অশোক তারা ও তার স্ত্রী, দুজনের সঙ্গেই শেখ হাসিনার দারুণ সুসম্পর্ক!
এমন কী ঢাকাতে কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন, এমন অনেক সাবেক ভারতীয় কর্মকর্তার সঙ্গেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে শেখ হাসিনার সৌহার্দ্য আছে।
বিবিসি বাংলা জানতে পেরেছে, গত একশো দিনের ভেতর তার পুরনো পরিচিত এই ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে কেউ কেউ শেখ হাসিনার সঙ্গে সামনাসামনি দেখা করারও সুযোগ পেয়েছেন। এই ধরনের ‘ভিজিটে’র সংখ্যা হাতেগোনা হতে পারে, কিন্তু ভারত সরকারও সচেতনভাবে তার ক্ষেত্রে এই ধরনের কিছু দেখা সাক্ষাতের অনুমতি দিয়েছে, যাতে তাদের ভিভিআইপি অতিথি মানসিকভাবেও চাঙ্গা থাকেন!
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কতটা অবাধ?
গত মাসতিনেকে শেখ হাসিনার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কথিত ফোনালাপের বেশ কিছু অডিও ‘ভাইরাল’ হয়েছে – যাতে একপক্ষের কণ্ঠস্বর হুবুহু শেখ হাসিনার মতোই শোনাচ্ছে।
ভারত যদিও এই সব ‘ফাঁস’ হওয়া অডিও নিয়ে সরকারিভাবে কোনও মন্তব্য করেনি, তবে একাধিক পদস্থ সূত্র একান্ত আলোচনায় স্বীকার করেছেন এগুলো বাস্তবিকই শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর!
দিল্লির নর্থ ব্লকের একজন কর্মকর্তা আবার বলছেন, “আমি জানি না এটা এআই দিয়ে বানানো হয়েছে না কি শেখ হাসিনার নিজেরই গলা– তবে তার তো পরিচিতদের সঙ্গে কথাবার্তা বলায় কোনও বিধিনিষেধ নেই, এখন কেউ যদি সেই আলাপ রেকর্ড করে লিক করে দেয়, তাতে আমাদের কী করার আছে?”
ভারতে কোনও কোনও পর্যবেক্ষক আবার ধারণা করছেন, শেখ হাসিনা যাতে নিজের দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়ে তাদের মনোবল ধরে রাখতে পারেন– সে জন্য দিল্লিই এই সব কথাবার্তা হতে দিচ্ছে এবং পরে সুযোগ বুঝে তা ‘লিক’ও করে দিচ্ছে, যাতে তা যত বেশি সম্ভব লোকের কাছে পৌঁছতে পারে!
বরিশালে আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়ার পর ভস্মীভূত আওয়ামী লীগ কার্যালয়। ৬ অগাস্টে তোলা ছবি। Getty Images
এর আসল কারণটা যা-ই হোক, বাস্তবতা হলো শেখ হাসিনা ভারতে কোনও গৃহবন্দিও নন বা রাজনৈতিক বন্দিও নন– ফলে দেশে-বিদেশে তার পরিচিতদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সুযোগ তিনি পাচ্ছেন।
ওই কর্মকর্তা আরও বলছিলেন, “ভারতে যখন কোনও রাজনৈতিক নেতা গৃহবন্দি হন, তার বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগযোগের অধিকারও কার্যত কেড়ে নেওয়া হয়!”
“যেমন ধরুন পাঁচ বছর আগে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ করার পর ওমর আবদুল্লা বা মেহবুবা মুফতিদের যখন গৃহবন্দি করা হয়, তারা কিন্তু দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেখা করা তো দূরস্থান – মোবাইল বা ইন্টারনেট সংযোগও পাননি!”
সুতরাং শেখ হাসিনা যে ভারতে মোটেই গৃহবন্দি নন– তার প্রমাণ তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিতই কথাবার্তা বলতে পারছেন।
দিল্লিতে থাকা মেয়ে সাইমা ওয়াজেদ বা ভার্জিনিয়াতে থাকা ছেলে সজীব ওয়াজেদের সঙ্গেও তার প্রায় রোজই যোগাযোগ হচ্ছে। নিউজ চ্যানেল, খবরের কাগজ বা ইন্টারনেটেও তার সম্পূর্ণ অ্যাকসেস আছে।
তবে ৫ই অগাস্টের পর থেকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের যে নেতাকর্মীরা পালিয়ে ভারতে চলে এসেছেন তাদের কারও কারও সঙ্গে শেখ হাসিনার যোগাযোগ হলেও এরা কেউই সশরীরে (ইন পার্সন) দলনেত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাননি।
ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিক পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। Getty Images
আর ভারতের মাটিতে বসে শেখ হাসিনা যাতে এখনই নিজের বয়ানে কোনও প্রকাশ্য রাজনৈতিক বিবৃতি না দেন, সে জন্যও তাকে ভারতের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে বলে বিবিসি জানতে পেরেছে।
আসলে শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দিয়ে তারপর তার মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে উসকানি দিতে চাইছে– এটা যাতে কেউ বলতে না-পারে, সে জন্যই দিল্লির এই সতর্ক অবস্থান!
আর যেহেতু শেখ হাসিনার নিজস্ব কোনও ভেরিফায়েড ফেসবুক বা এক্স অ্যাকাউন্টও নেই – ফলে এটাও দিল্লির স্বস্তির একটি কারণ, যে সেখানেও তার কোনও পোস্ট আসছে না!
কিন্তু বাংলাদেশে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পুনর্বাসন কি আদৌ সম্ভব? এই অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়টা নিয়ে দিল্লি কী ভাবছে?
ভারত এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি কথাও বলছে না সঙ্গত কারণেই, তবে ঢাকায় ভারতের সাবেক হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী মনে করেন, এই কাজটা শুধু কঠিন নয়– খুবই কঠিন!
“এখনও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সে দেশে ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছে, তাদের দলীয় সংগঠনও ছত্রভঙ্গ!”
“শেখ হাসিনার বয়স আজকের চেয়ে দশটা বছর কম হলে তবু হয়তো মনে করা যেত তিনি দেশে ফিরে দলের হাল ধরবেন– কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা প্রায় অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. চক্রবর্তী।
গত সপ্তাহে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মীও হয়তো ভাবছেন, তাদের নেত্রীর দেশে ফেরা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা!
তবে শেখ হাসিনা এই মুহূর্তে যে দেশের আতিথেয়তায় আছেন তারা কিন্তু এখনই অতটা আগ বাড়িয়ে ভাবতে রাজি নয়!
সাউথ ব্লকের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার কথায়, “পিচ এখনও প্রতিকূল, বল উল্টোপাল্টা লাফাচ্ছে। এরকম সময় চালিয়ে খেলতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে!”
“এখন বরং ধৈর্য দেখানোর সময়, ফলে প্রতিপক্ষের লুজ বলের জন্য অপেক্ষা করাটাই শ্রেয়,” ক্রিকেটের উপমা দিয়ে হাসতে হাসতে যোগ করেন তিনি!
রাজনীতির উইকেটে পোড় খাওয়া ব্যাটার শেখ হাসিনাও নিশ্চয় এটা জানেন এবং সেই অনুযায়ী উপযুক্ত সুযোগ এলে তবেই সেটা কাজে লাগাবেন– একশো দিনের মাথায় ভারতও আপাতত এটুকুতেই তাদের ভাবনা সীমিত রাখছে!