প্রথমবারের মতো কোনো বিশ্বকাপের শিরোপা জয় থেকে একধাপ দূরে দাঁড়িয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফির খোঁজে থাকা ভারত। চলতি টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত অপরাজিত দুই দলের লড়াইয়ে শেষ হাসি কারা হাসবে? কারাই বা ঘুচাবে শিরোপা খরা? এমন নানা প্রশ্ন ছিল ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে। সবচেয়ে বেশি উৎসাহ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে। অনেকে ধরে নিয়েছিলেন, এবার বুঝি তাদের চোকার তকমাটা ঘুচবে।
কিন্তু হলো না। কঠিন ম্যাচকে সহজ করেও জয়ের বন্দরে ভিড়তে পারলো না তারা। ফলে চোকার্স তকমাটা তাদের ললাট লিখন হয়েই রইলো। বার্বাডোজে বাংলাদেশ সময় শনিবার রাত সাড়ে ৮টায় চোকার তকমা ঘুচানোর জন্য মাঠে নেমে আবারও আক্ষেপের আগুনে পুড়ল দক্ষিণ আফ্রিকা। ভারতের কাছে তারা ৭ রানে হেরে গেল।
দারুণ সব প্রতিভাবান ও কিংবদন্তিদের নিয়ে গড়া দল নিয়েও শেষ মুহূর্তে গিয়ে কোনো শিরোপা জিততে না পারায় অনেকদিন আগেই চোকার তকমা সেঁটে গেছে প্রোটিয়াদের গায়ে। অন্যদিকে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে আইসিসির টুর্নামেন্টে দাপট দেখিয়েও শেষে কাঙ্ক্ষিত শিরোপার দেখা না পাওয়া ভারতকেও অনেকে এখন ডাকেন ‘আধুনিক যুগের চোকার’ হিসেবে। ফলে অনেকের কাছেই বার্বাডোজের ফাইনালটি ‘ঐতিহাসিক চোকার’ বনাম ‘নতুন চোকার’ – এর লড়াই হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল।
ভারত শাপমুক্ত হলো। দক্ষিণ আফ্রিকার কপাল থেকে চোকার অভিশাপটা আর গেল না।
অতীতে অসংখ্য টুর্নামেন্টে দেখা গেছে কখনও অদ্ভুত বৃষ্টি আইন, কখনও শেষ ওভারের নাটকীয়তা কিংবা কখনও নিজেদেরই ভুলে গত ৩২ বছরে সাত সাতটি ভিন্ন বিশ্বকাপে সেমি-ফাইনালের বাধা পেরুতে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে রবার্ট ব্রুসের মতো সাতবারের চেষ্টায় না পারলেও অষ্টমবারের চেষ্টায় তারা ঠিকই সেমি-ফাইনালের বাধা অতিক্রম করতে পেরেছিল এবারকার টি-২০ বিশ্বকাপে। সুযোগ ছিল দারুণ। ভারতকে ১৭৬ রানে বেঁধে ফেলেছিল তারা। ব্যাট করতে নেমেও এক পর্যায়ে খেই হারালে সামলে নিয়েছিল প্রোটিয়ারা। কিন্তু ৩০ বলে ৩০ রান হাতে ৬ উইকেট নিয়েও হেরে বসলো তারা!
১৯৯২ ওয়ানডে বিশ্বকাপ দিয়ে সেমি-ফাইনালে গিয়ে খেই হারানোর শুরুটা হয় দক্ষিণ আফ্রিকার। সেবার অদ্ভুত বৃষ্টি আইনের কারণে জয়ের দারুণ অবস্থানে থেকেও ইংল্যান্ডের কাছে ম্যাচ হারতে হয় ১৯ রানে। সিডনিতে বৃষ্টির কারণে খেলা বন্ধ হওয়ার আগে প্রোটিয়াদের দরকার ছিল ১৩ বলে ২২ রান। এরপর বৃষ্টি নামলে ১২ মিনিট খেলা বন্ধ থাকলে পরিবর্তিত লক্ষ্য দাঁড়ায় ১ বলে ২১ রানের।
এরপর ১৯৯৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে ল্যান্স ক্লুজনারের বীরত্বে দ্বারপ্রান্তে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু ১ রান বাকি থাকতে বাঁহাতি এই ব্যাটারের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে অ্যালান ডোনাল্ড রান-আউট হলে ম্যাচ টাই হয়। ফলে সুপার সিক্সে নেট রান-রেটে এগিয়ে থাকায় ফাইনালে যায় অস্ট্রেলিয়া।
২০০৭, ২০১৫ ও ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপের শেষ চারের বাধা অতিক্রম করতে পারেনি প্রোটিয়ারা। এর মাঝে ২০০৯ ও ২০১৪ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে জায়গা করে নিলেও পাকিস্তান ও ভারতের কাছে হেরে বাড়ি ফিরতে হয় খালি হাতেই।
তবে এবারের আসরে যেন এক ভিন্ন দক্ষিণ আফ্রিকাকে দেখছে ক্রিকেট বিশ্ব। আগের আসরগুলোতে ভাগ্যের সহায়তা না পেলেও এবার তা পেয়েছে প্রায় সব ম্যাচেই। গ্রুপ পর্ব থেকে সুপার এইটের প্রায় সব ম্যাচ জিতেছে লড়াই করেই। কেবল ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দিতে পেরেছে এইডেন মারক্রামের দল।
২০১১ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ের পর থেকে বিশ্ব মঞ্চে আর কোনো সাফল্য পায়নি ভারত। এরপর ২০১৫ বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে চোখের জয়ে বিদায় নিতে হয় মহেন্দ্র সিং ধোনির দলকে। পরের আসরেও শেষ চার থেকে ফিরতে হয় খালি হাতেই। গত বছর ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টে শিরোপার সবচেয়ে বড় দাবিদার হিসেবেই ফাইনালে ওঠে রোহিত শর্মার দল। কিন্তু কোটি ভারতীয়কে নিস্তব্ধ করে দিয়ে শিরোপা নিজেদের করে নেয় প্যাট কামিন্সের অস্ট্রেলিয়া।
এর মাঝে ২০১৪ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে ভঙ্গ হয় ভারতের দ্বিতীয় শিরোপা জয়ের স্বপ্ন। ২০১৬ সালে ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত পরের আসরে সেমি-ফাইনালে ধরাশায়ী হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে। ২০২২ আসরে ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে ইংল্যান্ডের কাছে তারা রীতিমত উড়ে যায়।
২০২১ ও ২০২৩ বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে উঠলেও সেখান থেকেও খালি হাতে ফিরতে হয় ভারতকে।
মজার ব্যাপার হলো, প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের অপেক্ষায় থাকা দক্ষিণ আফ্রিকা এবং দীর্ঘদিন বিশ্বকাপের শিরোপা খরায় থাকা ভারতের সবশেষ জেতা আইসিসির শিরোপা হলো চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। ১৯৯৮ সালে এই টুর্নামেন্টেই নিজেদের একমাত্র বড় কোনো শিরোপা জেতে প্রোটিয়ারা। আর ২০১৩ সালের আসরে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে নিজেদের সবশেষ আইসিসির শিরোপা জেতে ভারত। এরপর দীর্ঘদিনের হাহাকার ছিল শিরোপার। সে হাহাকার ঘুচলো তাদের। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা যেই হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিল, সেই হতাশায় আবারও ডুবল তারা। কবে আবার তারা ফাইনালে উঠবে, শিরোপা জয় করে চোকার তকমা ঘুচাবে— তা সময়ই বলে দেবে।