বিশ্বকাপের সময় লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর খেলা দেখলে কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার চোখে পড়বেই। ব্যতিক্রম কেবল আর্জেন্টিনা। দেশটির জাতীয় দলে কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার ছিল না, আজও নেই। আর্জেন্টিনা সবসময় কেন শ্বেতাঙ্গদের নিয়ে দল গঠন করে? তাদের দেশের কৃষ্ণাঙ্গরা গেল কোথায়? এই কাহিনী জানতে হলে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।
লাতিনে ফুটবল
লাতিন আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলীয় দেশ আর্জেন্টিনা। দুনিয়া কাঁপানো বিপ্লবী চে গুয়েভারা, কালজয়ী গল্পকার হোর্হে লুইস বোর্হেসের জন্ম এই দেশটিতে। বিখ্যাত ফুটবলার ম্যারাডোনাও ছিলেন আর্জেন্টাইন। আয়তনের দিক থেকে আর্জেন্টিনা লাতিন আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। এর উত্তরে বলিভিয়া ও প্যারাগুয়ে, পূর্বে ব্রাজিল ও উরুগুয়ে, পশ্চিমে বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে চিলির সীমান্ত। ফুটবল একসময় এই দেশগুলোর কাছে বিদেশিদের খেলা ছিল। এখন এটি তাদের সংস্কৃতির অংশ।
লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের মতো আর্জেন্টিনাও ইউরোপীয়দের উপনিবেশ ছিল। সে সময় দেশটির রাজধানী বুয়েনস এইরেসের বন্দরে ইউরোপীয় নাবিকরা অবসর সময়ে ফুটবল খেলতেন। তাদের এই খেলা শুরুতে অদ্ভুত লাগে স্থানীয়দের কাছে। দুই দলে ভাগ হয়ে ছোট্ট একটি বল নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে সাদা চামড়ার মানুষরা এ আবার কেমন খেলা? কিন্তু সাদাদের এই অদ্ভুত খেলা কখন যে আর্জেন্টাইন কিশোর-তরুণদের রক্তে মিশে গেছে, তারা নিজেরাই জানে না। দিন নেই, রাত নেই খেলতে শুরু করে তারা। ফুটবল নেশায় বিভোর হয়ে পড়ে জাতি। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে আর্জেন্টিনাতেই যে প্রথম ফুটবল ঘাঁটি গাড়ে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তারাই প্রথম গড়ে তোলে দক্ষিণ আমেরিকার প্রথম ফুটবল ক্লাব। ১৮৬৭ সালে জাতীয় দল তারাই প্রথম গঠন করে।
আর্জেন্টিনার দেখাদেখি ধীরে ধীরে ফুটবল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সীমান্তবর্তী দেশগুলো থেকে শুরু করে গোটা লাতিন আমেরিকায়। আর্জেন্টিনায় যেমন ফুটবলের ঈশ্বর মারাডোনার জন্ম হয়, তেমনি ব্রাজিল ও উরুগুয়ে পায় যথাক্রমে পেলে ও হোসে লিয়ান্দ্রো আন্দ্রাদেকে। পেলে ও আন্দ্রাদে দুজনই ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। কেবল পেলে ও আন্দ্রাদেই নন, ব্রাজিল ও উরুগুয়ের জাতীয় দলে কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় বরাবরই ছিল এবং আছে। এই দুই দেশ ফুটবল দুনিয়ার সম্মানজনক ট্রফি কখনো তাদের স্কোয়াডে কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় ছাড়া জেতেনি। লাতিন আমেরিকার এই দুই দেশে কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় থাকার কারণ দাস বাণিজ্য। ব্রাজিলের পেলে, ভালদির পেরেইরা, গারিঞ্চা বা উরুগুয়ের আন্দ্রাদে, ইসাবেলিনো গ্রাদিনের মতো বিশ্বখ্যাত ফুটবলারদের পূর্বপুরুষরা দক্ষিণ আমেরিকায় ক্রীতদাস হিসেবে এসেছিলেন।
কৃষ্ণাঙ্গহীন আর্জেন্টিনা দল
আফ্রিকানদের জোর করে যে কেবল ব্রাজিল ও উরুগুয়েতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তা নয়। ষোড়শ শতাব্দীতে ঔপনিবেশিক আমলে দাস ব্যবসায়ীরা আফ্রিকার মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চল থেকে আফ্রিকানদের আর্জেন্টিনাতেও নিয়ে যায়। কিন্তু ব্রাজিল বা উরুগুয়ের মতো তাদের বংশধরদের আর্জেন্টিনার জাতীয় দলে কখনো দেখা যায়নি। বিষয়টি অদ্ভুত, তবে বাস্তবতা এটাই। ব্রাজিল বা উরুগুয়ের সঙ্গে আর্জেন্টিনার ঔপনিবেশিক ইতিহাসে মিল থাকলেও খেলার মাঠে ভিন্নতা চোখে পড়ার মতো। আর্জেন্টিনা এ পর্যন্ত তিনবার বিশ্বকাপ জিতেছে। একবার ১৯৭৮ সালে। পরের বার ১৯৮৬ তে। অতিসম্প্রতি ২০২২ সালে। কিন্তু কোনোবারই আর্জেন্টিনার স্কোয়াডে কালো চামড়ার কোনো খেলোয়াড় ছিল না। একবারই কেবল ব্যতিক্রম ঘটেছিল। গত শতাব্দীর বিশের দশকে আর্জেন্টিনা দলে আলেজান্দ্রো দে লস সান্তোস নামে একজন ফরোয়ার্ড ছিলেন। ১৯২২ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত দেশটির জাতীয় দলের হয়ে খেলেছিলেন তিনি। সেটিই প্রথম এবং বোধ করি শেষ।
অথচ ব্রাজিল দলের দিকে তাকালে কালোরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তুখোড় কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলারে ঠাঁসা এক দল। ১৯৫৮ সালে দেশটির প্রথম বিশ্বকাপ জয় কৃষ্ণাঙ্গ পেলে ও গারিঞ্চার হাত ধরেই হয়। পরের বিশ্বকাপগুলোতে ছিলেন মার্সেলো ভিয়েরা ও উইলিয়ানের মতো ফুটবলাররা।
আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল ফুটবল দলে এই পার্থক্যের বড় কারণ দেশ দুটির জনসংখ্যা। আর্জেন্টিনার মাত্র ১ লাখ ৪৯ হাজার ৪৯৩ জন মানুষ নিজেদের আফ্রো-আর্জেন্টাইন হিসেবে পরিচয় দেয়, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার মাত্র দশমিক তিন শতাংশ! অন্যদিকে পেলের দেশের দেড় কোটি মানুষ কৃষ্ণাঙ্গ। এই কৃষ্ণাঙ্গরা ব্রাজিলের জনসংখ্যার ৭.৫ শতাংশ হলেও দেশটির ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ নিজেদের কৃষ্ণাঙ্গ বা মিশ্র জাতি হিসেবে পরিচয় দেয়।
লাতিন আমেরিকায় আর্জেন্টিনা আজ সবচেয়ে বেশি সাদাদের দেশ হিসেবে পরিচিত কারণ দেশটির সাড়ে চার কোটি জনসংখ্যার ৯৭ শতাংশই শ্বেতাঙ্গ। অথচ স্পেনীয় ঔপনিবেশিক আমলে দেশটিতে অনেক আফ্রিকান বাস করতেন।
লেখক এরিকা এডওয়ার্ডস এ নিয়ে গবেষণাবহুল একটি বই লিখেছেন। তার স্টোরি ইন আর্জেন্টিনা নামের সেই বইয়ে তিনি লেখেন, ‘১৫৮৭ সালে আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাসরা প্রথম বুয়েনস এইরাসে যান। ১৫৮০ থেকে ১৬৪০ সাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনার এই রাজধানী শহরে প্রধানত দাস ব্যবসাই হতো। সে সময় আর্জেন্টিনায় যত পণ্য আমদানি করা হতো, তার ৭০ শতাংশই ছিল দাস। অ্যাঙ্গোলাসহ পশ্চিম আফ্রিকার অন্যান্য দেশ থেকে ব্রাজিল হয়ে তাদের আর্জেন্টিনায় আনা হতো। বুয়েনস এইরাসে আনার পর দাসদের একাংশকে পেরু, চিলি, প্যারাগুয়ে, বলিভিয়াসহ লাতিন আমেরিকার অন্য দেশে পাঠানো হতো।’ সে সময় ঠিক কতজন আফ্রিকানকে আর্জেন্টিনায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, ১৬০১ থেকে ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত লাতিন আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলে ৬৩ হাজার ৮৪৫ জন আফ্রিকানকে নিয়ে যাওয়া হয়। একই সময়ে ব্রাজিলে যায় ৩০ লাখের বেশি আফ্রিকান।
ঔপনিবেশিক শাসককে দেশ থেকে তাড়াতে ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন আর্জেন্টাইন বিপ্লবী হোসে দে সান মার্তিন নিজের বাহিনী গড়ে তুলছিলেন, তখন তিনি হিসাব কষে দেখেন, চার লাখ আফ্রো-আর্জেন্টাইন তার সঙ্গে স্পেনীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লড়তে পারবেন। স্বাধীনতার জন্য ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করা মার্তিনের নেতৃত্বাধীন সেনাদের ৬৫ ভাগই ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। ঔপনিবেশিক যুগে আর্জেন্টিনার জনসংখ্যার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন। এই হার ২০০ বছরের মধ্যে দশমিক তিন শতাংশে এমনি এমনি নেমে আসতে পারে না। দেশটিতে কৃষ্ণাঙ্গ জনসংখ্যা খুব অল্প সময়ের মধ্যে কমে যায়। ইতিহাসবিদদের মতে, এই সময় ১৫ থেকে ২০ বছরের বেশি নয়। সেই সময়টিতে চালানো হয় কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর কৌশলগত জাতি নির্মূল অভিযান।
হোয়াইটওয়াশড জাতি
আজ বুয়েনস এইরাসে গেলে যে কারও মনে হবে, তিনি বুঝি স্পেনের কোনো শহরে এসে পড়েছেন। চারদিকে এত শ্বেতাঙ্গ! একসময় যে শহরটিতে কৃষ্ণাঙ্গরাও থাকত, তা বোঝার জো নেই। সাংস্কৃতিকভাবে, জাতিগতভাবে এমনকি স্থাপত্যগতভাবেও আর্জেন্টাইনদের হোয়াইটওয়াশ করা হয়েছে। ১৫ থেকে ২০ বছরের ভেতর আর্জেন্টিনায় আফ্রো-আর্জেন্টাইনদের সংখ্যা অবিশ্বাস্যভাবে কমে যাওয়ার গল্প বেশ করুণ ও নির্মম। পৃথিবীর মানুষ আজ মজ্জাগতভাবে বর্ণবাদী। এটি না হলে হয়তো আফ্রো-আর্জেন্টাইনদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ইতিহাস লাতিন তো বটেই গোটা বিশ্বের স্কুলের বইয়ে শিশুরা এ নিয়ে পড়ত।
আর্জেন্টিনায় আফ্রিকানদের জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়া কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। বরং ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে কৃষ্ণাঙ্গদের বাদ দিয়ে দেশটিতে শ্বেতাঙ্গ সমাজ নির্মাণ করা হয়। আর্জেন্টিনায় কেন এই বর্ণবাদী সমাজ গড়ে তোলা হয়, তা বুঝতে সে সময়ের প্রতিষ্ঠিত মতাদর্শ জানা জরুরি। আর্জেন্টিনা রাষ্ট্র সৃষ্টির শুরুর পর্বে যে কয়টি মতাদর্শ প্রভাব বিস্তার করেছিল, তার একটি হলো ইউরোকেন্দ্রিকতা। এই মতাদর্শের সমর্থকরা মনে করতেন, দেশে বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক সংকট থেকে বের হতে গেলে সম্ভাব্য সব ক্ষেত্রে ইউরোপকে অনুকরণ করাটাই হবে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। মারিয়ানো মোরেনো, বারনারদিনো রিভাদেভিয়ার মতো আর্জেন্টিনার প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রনায়করা ইউরোকেন্দ্রিকতার অনুসারী ছিলেন। দেশটির সপ্তম প্রেসিডেন্ট দোমিঙ্গো ফাউস্তিনো সারমিয়েন্তো ছিলেন ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্ববাদের কট্টর সমর্থক।
১৮৬৮ থেকে ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত আফ্রো-আর্জেন্টাইনদের কাঠামোগত নির্মূলের জন্য তাকে দায়ী করা হয়। সারমিয়েন্তোর শাসনামলে কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যায়। সারমিয়েন্তোর নেতৃত্বাধীন সরকার চেয়েছিল, লাতিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা যেন পশ্চিম ইউরোপের সম্প্রসারিত ভূখণ্ড হয়, যেখানে কেবল শ্বেতাঙ্গরাই বাস করে। এই লক্ষ্যে তাদের ভয়াবহ ও নিষ্ঠুর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়। কৃষ্ণাঙ্গদের ইউরোপীয়দের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দূরে বসবাসের ব্যবস্থা করেন প্রেসিডেন্ট সারমিয়েন্তো, যেখানে না ছিল চিকিৎসাসেবা, না ছিল বাসযোগ্য বাড়িঘর। সারমিয়েন্তোর ওই পদক্ষেপ কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য ছিল মৃত্যু পরোয়ানা। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আর্জেন্টিনায় কলেরা ও হলুদ জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গ বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত অঞ্চলে মহামারী ঠেকানো বা চিকিৎসা দেওয়ার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ ইচ্ছে করেই নেয়নি সরকার। সারমিয়েন্তোর গণহত্যা পরিকল্পনা অবশ্য এখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আফ্রো-আর্জেন্টাইনদের সেনাবাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক করেন তিনি। ১৮৬৪ সালে প্যারাগুয়ের সঙ্গে আর্জেন্টিনার যুদ্ধ লাগলে কৃষ্ণাঙ্গদের সারমিয়েন্তো যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠান এবং সেখানেও বহু কৃষ্ণাঙ্গ মারা যায়। ১৮৯৫ সালের মধ্যে আফ্রো-আফ্রিকানদের সংখ্যা নিদারুণভাবে কমে যায়। এরপর আর্জেন্টিনা সরকার তাদের জাতীয় আদমশুমারিতে অন্তর্ভুক্ত না করার সিদ্ধান্ত নেয়।
বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা
কেবল সারমিয়েন্তোর মতো রাষ্ট্রনায়কই কৃষ্ণাঙ্গ নিধনে ভূমিকা রেখেছিলেন, তা নয়। আর্জেন্টিনার তাঁবেদার বুদ্ধিজীবী সমাজও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তারা চেয়েছিল, সংস্কৃতি থেকে শুরু করে জীবনের সর্বস্তরে আর্জেন্টাইনদের কৃষ্ণাঙ্গমুক্ত হতে হবে। ট্যাঙ্গোর জন্য বিখ্যাত আর্জেন্টিনা। এই নৃত্যের উৎপত্তিতে শ্বেতাঙ্গ আর্জেন্টাইনরা ভূমিকা রাখেন বলে সবাই জানে এবং মানে। কিন্তু ট্যাঙ্গোর শেকড় অন্য জায়গায়। আফ্রিকার পশ্চিমাঞ্চলে বাস করা কৃষ্ণাঙ্গদের নাচ এই ট্যাঙ্গো। কৃষ্ণাঙ্গ আর্জেন্টাইন লোকশিল্পী ও সংগীতজ্ঞ গ্যাবিনো এজিয়েজার (নিগ্রো নামে পরিচিত) ছাত্র ছিলেন কিংবদন্তি শ্বেতাঙ্গ আর্জেন্টাইন ট্যাঙ্গো নৃত্যশিল্পী কার্লোস গার্ডেল। ট্যাঙ্গোর শরীর থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের গন্ধ দূর করতে সে সময় কম কাঠখড় পোড়াননি আর্জেন্টিনা সরকারের পোষা সংস্কৃতিকর্মী ও বুদ্ধিজীবী মহল। আর্জেন্টিনার গর্বের ট্যাঙ্গো যে আফ্রিকানদের থেকে অনুপ্রাণিত, তা তারা কখনো স্বীকার করতে চান না।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে দেশটির বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী সমাজের উদারপন্থি সদস্যরা ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্ববাদের সমালোচনা করতে শুরু করেন। তাদের সমর্থনে নামে প্রতিবেশী দেশগুলোও। মেক্সিকান বুদ্ধিজীবী হোসে ভাসকনসেলোস সে সময় বলেন, লাতিন আমেরিকাকে বহু সংস্কৃতির আধার হতে হবে, তবেই তার মঙ্গল হবে। আর্জেন্টিনার প্রগতিশীল এই অংশের চেষ্টা সত্ত্বেও দেশটিতে যাওয়া ইউরোপীয় অভিবাসীরা বরাবরই জামাই আদর পেয়ে আসেন। ইউরোপীয়দের কারণেই যে দেশ বারংবার উন্নতি করে, তা প্রচারে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নামে আর্জেন্টিনার সরকার ও দেশটির সংবাদমাধ্যম।
এক শতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, পরিস্থিতি খুব সামান্যই বদলেছে। কৃষ্ণাঙ্গ ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ আজও আর্জেন্টিনায় দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। অ-ইউরোপীয় অভিবাসীদের প্রতি অবজ্ঞার দৃষ্টি পাল্টায়নি। থেমে নেই বর্ণবাদী গালাগালি। শ্রেণিবৈষম্য দিন দিন প্রকট হচ্ছে। আর্জেন্টিনার বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব বোকা জুনিয়র্সকে প্রায়ই বর্ণবাদী মন্তব্য শুনতে হয়। বোকা জুনিয়র্স শুরু থেকেই শ্রমিক শ্রেণির ক্লাব হিসেবে পরিচিত। তাদের সঙ্গে অভিজাত শ্রেণির ক্লাব রিভার প্লেটের শত্রুতা সর্বজনবিদিত। আর্জেন্টিনার সংবিধান আজও ইউরোপীয়দের বিষয়ে বেশ দুর্বল। শাসক শ্রেণির ঔপনিবেশিক চিন্তাভাবনা ও বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দূর হওয়ার আগ পর্যন্ত তরুণ কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলারকে চে-ম্যারাডোনা-মেসির আর্জেন্টিনার জাতীয় দলে দেখা যাবে না, এটাই স্বাভাবিক।
বিবিসি, রয়টার্স ও গ্লোবো ডটকম