Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the all-in-one-seo-pack domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/priodesh/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121

Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the sharethis-share-buttons domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/priodesh/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
বিষ খাচ্ছেন না তো? - Priodesh

বিষ খাচ্ছেন না তো?

লুৎফর রহমান হিমেল
27 June 2024 6:59 pm
খাদ্যে বিষ বা ভেজাল এখন বড় হুমকি

দেশের এই ভয়ঙ্কর ভেজাল খাদ্য বা বিষযুক্ত খাদ্যই এখন বড় হুমকি।

আপনি যে সকালের নাস্তাটা খাচ্ছেন, ঠিক আছে তো? দুপুরে যে ভাতটা খাচ্ছেন, সেই চালে কি পরিমান বিষাক্ত পাউডার ছিল, খোঁজ নিয়েছেন কোনোদিন? সকাল দুপুর রাতে যে দুধটা দিয়ে চা খাচ্ছেন, দুধটা দুধ তো, নাকি কৃত্রিম কিছু? টসটসে আঙুরটি যে টুপ করে মুখে পুরলেন, তাতে যে স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ঙ্কর ফরমালিন ছিল না, তার গ্যারান্টি কি?

এসব প্রশ্ন শুনে আপনি ভাবছেন, দেশে এতো ইস্যু থাকতে আমি কেন খাবার নিয়ে লিখতে এলাম। আমি নিজে ভুক্তভোগি হিসেবে মনে করি, দেশের এই ভয়ঙ্কর ভেজাল খাদ্য বা বিষযুক্ত খাদ্যই এখন বড় হুমকি। অথচ এটা কারো আলোচনার হিসাবের খাতায় নেই। পত্র-পত্রিকায় এ লেখালেখি খুবই কম চোখে পড়ে। অথচ খাবারে ভেজাল যে কতটুকু ভয়াবহ রূপ নিয়েছে তার নমুনা মেলে নানা পরীক্ষায়।

গত বছর নভেম্বর থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত ৪০৫টি খাবারের নমুনা পরীক্ষা করেছিল জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট। সেই পরীক্ষায় ৪৭টি খাদ্যের নমুনাতেই মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক রাসায়নিকের উপস্থিতি মিলেছে। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাগারে ফল, সবজি, মুড়ি, কাঁচা মরিচ, হলুদের গুঁড়ার নমুনা পরীক্ষা করে এই ফল পাওয়া গেছে। এটাতো গেল সীমিত আকারের পরীক্ষা; বড় অভিযানে নামলে ভয়াবহ সব তথ্য বেরিয়ে আসবে।

২০১৪ সালেও ঢাকার বিভিন্ন বাজার থেকে ফল সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেছিল পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) নামের আরেকটি সংগঠন। সংগ্রহ করা নমুনার মধ্যে ৯৫ ভাগ লিচু এবং ১০০ ভাগ জামে বিষাক্ত ফরমালিনের উপস্থিতি পেয়েছিল সংগঠনটি। এ ছাড়া অন্যান্য ফলেও ফরমালিন পাওয়া গেছে।

খাদ্যে বিষ। এ কথা বেশি করে শুনে আসছি বিগত ১৫-২০ বছর ধরে। এরপর থেকে আমরা উপায়ন্তর না পেয়ে ‘জেনেশুনে বিষ’ পান করে চলেছি। ভয়াবহ এই অপরাধ যারা করে তাদের ব্যাপারে আজ পর্যন্ত বড় কোনো উদ্যোগের কথা আমাদের জানা নেই।

যদিও ১ ফেব্রুয়ারি থেকে নিরাপদ খাদ্য আইন কার্যকর করেছে সরকার, যাতে খাদ্যে ভেজালের জন্য পাঁচ বছর কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ব্যাস, এই টুকুই। কাগজে কলমে আইনটি পেয়েছি, এটিই সার। কিন্তু তার বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত লোক নেই। অথচ সারাবিশ্বেই খাদ্যে ভেজাল মেশানোর শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান পর্যন্ত রয়েছে।

দেশে ভেজাল পরীক্ষা করা ও মনিটর করার জন্য বিএসটিআই নামে একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান আছে। দেশের খাদ্যমান নিয়ন্ত্রণকারী একমাত্র এই প্রতিষ্ঠান নিজেই জানে না এতো বিষ ও ভেজালের ভীড়ে আসলে কি করা উচিৎ, কোথা থেকে শুরু করা উচিত। তাদের সেই সামর্থ্যও নেই। এ যেন হাতির সাথে পিপড়ের যুদ্ধ।

সামান্য চানাচুরের কথাই ধরেন। শৈশবে স্কুলে গিয়ে আপনি চানাচুর খেয়ে যে মজাটা পেতেন, সেটা আর এখন নেই। কোথায় গেল সেই মজা? হ্যাঁ, সেই চানাচুরের বড় উপাদান ছিল ডাল। এখন সেই ডালের জায়গায় এসেছে আটা। আটাতো আটা, পচা আটা। চানাচুরের মজা আসবে কোথা থেকে? আমি নিজে বোম্বে চানাচুরের রীতিমত ফ্যান ছিলাম।

এখন বাজারে বোম্বের পাশাপাশি শতশত ব্রান্ডের চানাচুর। চানাচুরের চকচকে আধুনিক প্যাকেট পেয়েছি আমরা, কিন্তু স্বাদটা আর পাইনি। প্যাকেটগুলো দেখলেই কিনতে ইচ্ছে করে। আমরা এগুলো দেদার কিনিও। কিনে সেই প্রতারণার ফাঁদে পা দেই। চানাচুর আর সেই চানাচুর নেই।

নাস্তার টেবিলে পরিবেশিত কলাটায় কি ১৫-২০ বছর আগের সেই স্বাদ-ঘ্রাণটা পাচ্ছেন? পাচ্ছেন না। পাবেন কিভাবে? কলায় দেওয়া হচ্ছে বিষাক্ত স্প্রে। কলার জন্ম থেকেই শুরু হয় বিষ মেশানোর প্রক্রিয়া। এরকম জন্ম থেকেই বিষে জর্জরিত আম, জাম, তরমুজ, পেঁপে সব মৌসুমী ফলই। কোনো ফলই বিষমুক্ত থাকতে পারছে না। এসব খেয়ে বাড়ছে দূরারোগ্য ব্যাধি।

এই ১০-১৫ বছর আগেও ক্যান্সার ছিল সিনেমার রোগ। রূপালি জগতের পর্দায় নায়ক নায়িকার ক্যান্সার হতো। বাস্তবজগতে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। কিন্তু এখন? আমার নিজেরই পরিচিত অনেকের স্বজনের খোঁজ পাই, ক্যান্সারে আক্রান্ত। ধুকে ধুকে মৃত্যুর প্রহর গুনছে তারা। কেউবা লিভার বা কিডনির জটিল রোগে আক্রান্ত।

এসবের বেশিরভাগই হচ্ছে এই খাদ্য বিষ ক্রিয়ার ফল। কিন্তু এসব নিয়ে পত্র-পত্রিকায় জোরালো কোনো লেখালেখি হয় না। ফলে, সরকারগুলোও জনস্বাস্থ্য নিয়ে বড় পদক্ষেপ নেয় না। তারা রুটিনমাফিক কিছু অভিযান চালায়। সামান্য জেল, জরিমানায় সেই উদ্যোগ কিছুদিনের মধ্যে চাপা পড়ে যায়।

অথচ যারা খাদ্যে ভেজাল করে কোটি কোটি মানুষকে মৃত্যুঝুঁকিতে ফেলছে, তারাতো এক হিসেবে গণহত্যার অপরাধ করছে। সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযানে যতো গুরুত্ব দেওয়া হয়, তার এক ছিটেফোটাও খাদ্যে ভেজাল ও বিষ মেশানোর সাথে জড়িতদের ব্যাপারে নেওয়া হয় না।

সিঙ্গাপুরে নামকরা হাসপাতালগুলোতে বিভিন্ন দেশ থেকে রোগীদের আনা-নেওয়া ও চিকিৎসা তদারক করার জন্য আলাদা আলাদা কর্মকর্তা বা এজেন্ট থাকেন। বাংলাদেশি রোগীদের জন্যও আছেন বাংলাদেশি এজেন্ট। সেই এজেন্টদের কয়েকজনের সাথে আমার কথা হয়েছিল দেশটিতে বেড়াতে গিয়ে। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি রোগীর আসার হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে আশংকার কথা জানিয়েছিলেন তারা।

এই রোগীদের প্রায় সবাই অর্থনৈতিকভাবে বেশ সচ্ছল। অথচ এদের বড় অংশ বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে একটা পর্যায়ে পথে বসেছেন। চিকিৎসকরা বলেছেন, এসব রোগ হচ্ছে ভেজাল খাদ্য খাওয়ার জন্য।

সরকারের উচ্চপর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তাকে একবার এ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, খাদ্যে ভেজাল রোধে আপনারা শক্ত হাতে কিছু করছেন না কেন। তারা হতাশ হয়ে বলেছিলেন, ‘ভেজালটা কম হলে কিছু করা যেত। এটা এত গভীরে বিস্তৃত যে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হওয়ার উপক্রম হবে। এরপর সংকট সৃষ্টি হবে। তখন সবাইকে না খেয়ে মরতে হবে।’

ভেজালের বিষক্রিয়া আমরা সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি না বলে এ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে হৈচৈ কম। শরীরের ক্ষতি করতে এটা সাধারণত কয়েক বছর সময় নেয়। ধীরে ধীরে নিঃশব্দ ঘাতকের মতো কিডনি, হার্ট, পাকস্থলি অকেজো করতে থাকে। যদি ধরে নেওয়া যায়, ১০-১৫ বছর আগে থেকে আমাদের দেশে এই ভেজাল মহামারির পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাহলে ভবিষ্যতে এ কারণে প্রতিবছর আমাদের অনেকের প্রিয়জনের অকালমৃত্যু হবে। ঘরে ঘরে হাহাকার উঠবে।

ফেসবুকে কবি ও সাংবাদিক মিনার মনসুর সম্প্রতি একটি মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বেবী আমার কলেজ জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এখন হাসপাতালে। সকালে ওকে দেখতে গিয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আমার বন্ধুবৃত্ত খুব ছোটো। ক্ষুদ্র সেই বৃত্ত থেকেই তিনজনকে অকালে থাবা দিয়ে নিয়ে গেছে ক্যান্সার।

তার মধ্যে দুজনই ডাক্তার। আরও দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু আক্রান্ত। একজন ক্যান্সারকে রুখে দিয়েছে। অন্যজন লড়ছে। আমার আশঙ্কা, দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কোথাও ভয়ঙ্কর কিছু একটা হচ্ছে নিভৃতে। আমরা হয়তো টের পাচ্ছি না কিংবা পেলেও বিপদটা ঠিকমতো আঁচ করতে পারছি না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বেবী ঠিকই সেরে উঠবে। কিন্তু অর্থের লোভে যারা খাদ্যে বিষ মেশানোসহ নানাভাবে গোটা সমাজটাকে নিশ্চিত বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তাকে সারাবে কে?’

হাজারো সমস্যার মধ্যেও আমরা এগিয়ে চলা জাতি। চায়ের আড্ডায় রাজনৈতিক দলগুলোর নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু কীভাবে নিজেদের ভেতর ভেজালবিরোধী সচেতনতা তৈরি করা যায়, সেটা নিয়ে মাথা ঘামাই না। সরকারের পাশাপাশি দেশের জনগণের সচেতনতা খুব বেশি জরুরি। আবারও প্রয়োজন সেই ম্যাজিস্ট্রেট রোকন উদ-দৌলার মতো উদ্যমী কর্মকর্তাদের।

আমি ঠিক জানি না কি কারণে ম্যাজিস্ট্রেট রোকন নিজেই সবার আড়ালে চলে গেছেন। এক সময় তার নাম শুনলেই অন্তর-আত্মা কেঁপে উঠতো খাদ্যে ভেজালকারী অসাধু ব্যবসায়ীদের। সবসময়ই তারা আতঙ্কে থাকতো- এই বুঝি তিনি এলেন আর ধরা পড়ে গেল সব। কিন্তু এখন? বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভেজালে ছেয়ে গেছে দেশের খাদ্যপণ্য। কী গ্রাম, কী শহর, কোথাও ভেজাল ছাড়া কোনো খাদ্যপণ্য মেলে না।

ভয়াবহ খাদ্যপণ্যের এই মহামারি যদি এখনই শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, বেশি দিন নয়, ১৫-২০ বছর পর বাংলাদেশে সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে!

লেখক: সম্পাদক-প্রকাশক, প্রিয়দেশ ডটকম।