কোটা আন্দোলনে নিহত ৬, দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ

নিজস্ব প্রতিবেদক
17 July 2024 1:37 am
ঢাকা কলেজের সামনের সড়কে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগ কর্মীরা মুখোমুখি অবস্থান নেয়।

ঢাকা কলেজের সামনের সড়কে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগ কর্মীরা মুখোমুখি অবস্থান নেয়।

নিজস্ব প্রতিবেদক

কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সাথে সহিংসতায় একদিনেই (মঙ্গলবার) সারা দেশে ছয় জনের নিহত হওয়ার খবর মিলল। এদের মধ্যে শিক্ষার্থী ও পথচারী রয়েছে। এদিন সকালে ঢাকাসহ সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করতে শুরু করে। ফলে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বগুড়াসহ অনেক শহরের প্রধান সড়কগুলো অচল হয়ে যায় এবং মহাসড়কেও যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

ঢাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরাও সড়কে অবস্থান নেয়ায় কয়েকটি স্থানে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলও ছাড়তে হবে। এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের চিঠি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

মঙ্গলবার রাতে ইউজিসি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কাছে দেওয়া এক চিঠিতে বলেছে, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে দেশের সব পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত মেডিকেল, টেক্সটাইল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও অন্যান্য কলেজসহ সব কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।

এর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠান) এবং পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোর শ্রেণি কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধের ঘোষণা দেয় মন্ত্রণালয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোও বন্ধ ঘোষণা করা হয়। আগামী বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠেয় সব শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়।

৬ জন নিহত এবং সারাদিন যা ঘটলো

সকাল থেকেই অনেক স্থানে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। ছাত্রলীগ কর্মীদের সাথে তাদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, ইট পাটকেল নিক্ষেপের মতো ঘটনা ঘটে। রংপুরে লাঠিচার্জ ও গুলি করে পুলিশ ।

এসব সহিংসতায় ঢাকায় দুইজন, রংপুরে একজন, চট্টগ্রামে তিনজনের মৃত্যুর খবর জানা যায়।

গতকাল সোমবার সারা দেশে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের হামলা, কোটা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার এবং কোটা প্রথার যৌক্তিক সমাধানের দাবিতে মঙ্গলবার নতুন করে বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থীরা।

এর ফলে ঢাকার বিভিন্ন সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, হাইওয়েগুলোতে মাইলের পর মাইল ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে শতশত যানবাহন। এ সময় যাত্রীরা নিদারুণ ভোগান্তিতে পড়েন।

ছাত্রলীগও আজ দুপুর থেকে তাদের ওপর হামলার প্রতিবাদে সমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে এবং পরদিন বেলা দেড়টা থেকেই দেশজুড়ে এ বিক্ষোভ শুরু হওয়ার কথা।

গতকালের হামলায় ঢাকায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

সোমবারে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা এবং সহিংসতার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর।

প্রসঙ্গত, রবিবার গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর করা এক মন্তব্যের পর ওই রাতেই নতুন করে ছাত্রদের বিক্ষোভ শুরু হয় ঢাকাসহ সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এরপর সোমবার ঢাকাসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলার ঘটনা ঘটে।

তবে, ছাত্রলীগ এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে উল্টো তাদের কর্মীদের ওপর আন্দোলনকারীরা হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করে।

যুক্তরাষ্ট্র এবং অ্যামনেষ্টির নিন্দা

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেছেন, বাংলাদেশের চলমান শিক্ষার্থী বিক্ষোভের ঘটনা তারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে যে কোন ধরনের সহিংসতার তারা নিন্দা জানায়।

তিনি বলেন, আমরা ঢাকা ও বাংলাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়া শিক্ষার্থী বিক্ষোভের বিষয়ে সজাগ আছি এবং পর্যবেক্ষণ করছি, এরমধ্যে দুজন নিহত হয়েছে এবং শত শত আহত হয়েছে।

মিলার আরো বলেন, মতপ্রকাশ ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা যেকোনো ক্রমবিকাশমান গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য বিষয়। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে যেকোনো সহিংসতার নিন্দা জানাই। যারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন, তাদের প্রতিও সমবেদনা জানাচ্ছি।

মুখপাত্র মিলারের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী সাবরিন মঙ্গলবার দুপুরে এক বিবৃতিতে বলেন, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে দুইজনের মৃত্যুর যে দাবি করেছেন, তার স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। যাচাই না করে ভিত্তিহীন তথ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এমন মন্তব্য সহিংসতাকে উসকে দিতে পারে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সারাদেশে কোটা বিরোধী বিক্ষোভে হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। সংস্থাটি বিক্ষোভকারীদের পূর্ণ নিরাপত্তা এবং আহতদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্যও সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে।

আন্দোলন-বিক্ষোভে রাজধানী অচল

সারাদেশের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভ কর্মসূচির অংশ হিসেবে মঙ্গলবার দুপুর দুইটার দিক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মিছিলসহ ঢুকতে শুরু করে। নানা ধরণের পোস্টার, প্লাকার্ড হাতে নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রবেশ করতে দেখা যায়।

ঢাকার নতুন বাজার এলাকা ছাড়াও প্রগতি সরনী, বনানী ছাড়াও উত্তরা এলাকায় সড়ক অবরোধ করে অবস্থান নেয় বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে প্রগতি সরনী অবরোধ করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।

রামপুরা ব্রিজ এলাকায় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এসে ব্রিজের ওপর অবস্থান নেয়। এতে রাস্তার দু পাশেই যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া, বনানীর কাকলি এলাকায় সড়কে অবস্থান নেয় প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ কারণে শহরের ব্যস্ততম এলাকাটিতে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

একই পরিস্থিতি তৈরি হয় নগরীর আরেক ব্যস্ত এলাকা মিরপুর-১০ গোলচত্বরে। সেখানেও আশেপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এর পুরো ক্যাম্পাসই শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং তারা লাঠিসোটা নিয়ে মিছিল করে। এরমধ্যে একটি হলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের আটকে রাখে।

পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট মিটিং হয় কয়েক দফা।

ঢাকার বাইরে ময়মনসিংহে টাউন হল এলাকায় সড়ক অবরোধ করে অবস্থান নেয় কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। ফলে শহরের ভেতরে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে কয়েকটি এলাকা প্রদক্ষিণ করে এসে আবার কলেজের সামনে সড়কে অবস্থান নেয়।

রাজশাহীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে। বিক্ষোভের খবর মিলেছে ঝিনাইদহের বিভিন্ন স্কুলের মাঠে আন্দোলনকারীদের অবস্থান নেওয়ার। সেখানে আন্দোলকারীদের ওপর হামলা হয়েছে এবং এ ঘটনায় কয়েকজন আহত হয়।

কোটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কী বলেছিলেন?

রবিবার চীন সফর উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, কোটা নিয়ে আদালত থেকে সমাধান না আসলে সরকারের কিছু করার নেই।

প্রসঙ্গক্রমে তিনি প্রশ্ন করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?

প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের জের ধরে ওই রাত থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়। সরকারি চাকুরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মিছিল সমাবেশে মধ্যরাতে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, সিলেটের শাহজালাল ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

সেসময় কয়েকটি ক্যাম্পাসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ ওঠে।

মধ্যরাতে মিছিলকারীরা আবাসিক হলগুলো থেকে বেরিয়ে এসে ‘তুমি কে আমি কে – রাজাকার, রাজাকার’, ‘চাইতে গেলাম অধিকার- হয়ে গেলাম রাজাকার’ এবং ‘কোটা নয় মেধা- মেধা মেধা’- এ ধরনের স্লোগান দিয়ে মিছিল করতে থাকে।

অবশ্য ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের একটি অংশের ‘তুমি কে আমি কে – রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগান নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয় সামাজিক মাধ্যমে।

যদিও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবি, ‘প্রধানমন্ত্রী সবাইকে রাজাকার বলায় তারা এমন স্লোগান দিয়েছেন।’

নতুন কর্মসূচি

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন মঙ্গলবার রাতে। নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে বুধবার গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল করবেন তাঁরা। মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা ২০ মিনিটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে এই কর্মসূচির ঘোষণা দেন কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এর অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ।