হোলি আর্টিজান : যে হামলার দাগ রয়ে যাবে বহুকাল

নিজস্ব প্রতিবেদক
1 July 2024 2:09 pm
হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা বিশ্বকেও নাড়িয়ে দিয়েছিল

হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা বিশ্বকেও নাড়িয়ে দিয়েছিল। ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের ইতিহাসে বিভীষিকাময় দিনগুলোর অন্যতম একটি দিন হোলি আর্টিজান বেকারি হামলা। স্মৃতিপটে রক্তের দাগ আর বুলেটের ক্ষত নিয়ে বছর ঘুরে ফিরে আসে বিভীষিকাময় দিনটি। পয়লা জুলাই রাজধানীর অভিজাত গুলশান এলাকার ওই রেস্টুরেন্টে হামলা চালায় জঙ্গিরা। তাদের হাতে জিম্মিদের উদ্ধারে কমান্ডো অভিযানে নামে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান। গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ১১ ঘণ্টা পর ওই অভিযানটি শুরু হয়।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে একদল জঙ্গির নৃশংসতার দৃশ্য দেখেছিল গোটা দুনিয়া। শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল তা। ওই ঘটনার পর জঙ্গি দমনে শুরু হয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান।

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান ডিআইজি আসাদুজ্জামান মনে করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সেই অভিযানে সাফল্য এলেও ‘জঙ্গিবাদের বীজ’ এখনও রয়ে গেছে। সে কারণে মাঝেমধ্যেই তারা নাম বদলে তৎপরতা চালানোর চেষ্টা করছে।

জঙ্গিদের বেশিরভাগই অভিজাত উচ্চশিক্ষিত পরিবারের সন্তান। ছবি : সংগৃহীত

জঙ্গিদের বেশিরভাগই অভিজাত উচ্চশিক্ষিত পরিবারের সন্তান। ছবি : সংগৃহীত

রাজধানীর গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর বাড়িটি আজও সবার কাছে আলোচিত এক স্থান। এই বাড়িতেই ছিল হোলি আর্টিজান বেকারি। সেখানেই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায় বাংলাদেশের পাঁচ তরুণ।

তখন রোজার মাস। আর ওই বেকারি ছিল বিদেশিদের পছন্দের জায়গা। নিজেদের অবস্থান জানান দিতে ওই রেস্তোরাঁকেই বেছে নেয় জঙ্গিরা।

পাঁচ তরুণের ওই দলটি সশস্ত্র অবস্থায় হোলি আর্টিজান বেকারিতে ঢুকে পড়ে। গুলি চালিয়ে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে।

নিহতদের মধ্যে নয়জন ইতালির, সাতজন জাপানের, একজন ভারতীয়, দুজন বাংলাদেশি, একজন বাংলাদেশি-আমেরিকান নাগরিক ছিলেন। এর বাইরে হামলা ঠেকাতে গিয়ে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা।

সারারাত নির্ঘুম কাটে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সংবাদ কর্মীসহ কোটি কোটি মানুষের। নজিরবিহীন সেই রাতে সবার চোখ আটকে ছিল টেলিভিশনের পর্দায়। ভেতরের পরিস্থিতি জানতে এবং নিয়ন্ত্রণে আনতে নানা পরিকল্পনা চলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। শীর্ষ কর্মকর্তারা দফায় দফায় বৈঠক করেন। কিন্তু সময় গড়িয়ে গেলেও কোনো সিদ্ধান্তে আসতে না পারায় সেনাবাহিনী ডাকা হয়। পরদিন সূর্য ওঠার আগে শুরু হয় সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযান।

সেই অভিযানে হোলি আর্টিজানের নিয়ন্ত্রণ নেয় কমান্ডোরা, পাঁচ জঙ্গির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রুদ্ধশ্বাস সংকটের অবসান ঘটে। নিহত সেই ৫ জঙ্গি হলেন : নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল, মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল। এদের বেশিরভাগই উচ্চশিক্ষিত অভিজাত পরিবারের সন্তান!

ধীরে ধীরে জানা যায়, হোলি আর্টিজানে হামলার বেশ কিছুদিন আগেই ওই তরুণরা বাসা থেকে বেরিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছিল। তাদের কারো কারো পরিবার থানায় জিডিও করেছিল। গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ায় ওই ঘটনা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল। দেড় ডজন বিদেশি নাগরিক নিহত হওয়ায় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোও বড় পরিসরে সেই খবর প্রকাশ করে।

হোলি আর্টিজেন হামলার পর গুলশান থানায় দায়ের করা মামলার বিচার চলে প্রায় সাড়ে তিন বছর। পুলিশ ওই ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করে। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল সাতজনের ফাঁসির রায় দেয়। কিন্তু ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ে ওই সাতজনের সাজা পাল্টে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় হাই কোর্ট।

সাজাপ্রাপ্তরা হলেন : জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র‌্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন।

ওই ঘটনার দেড় দশক আগে থেকেই জঙ্গিবাদ দমনে তৎপর ছিল দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু হোলি আর্টিজানের মত এক বড় ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, তার কোনো আভাস, কোনো বাহিনীর কাছে ছিল না।

সে কারণে ওই ঘটনার পর জঙ্গি দমন কার্যক্রম ঢেলে সাজানো হয়। এখন র‌্যাবের বিশেষ উইং, ঢাকা মহানগর পুলিশের সিটিটিসি ছাড়াও অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট নামে পুলিশের আলাদা বিভাগ জঙ্গিবাদ দমনে কাজ করছে।

সিটিটিসি’র প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, “আমরা জঙ্গি দমনে সফলতা পেয়েছি। তবে তারা এখনো ভিন্নভাবে নাম বদলে তাদের তৎপরতা চালানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। নিয়মিত মনিটরিংয়ের কারণে যেখানেই তাদের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়, সেখানেই অভিযান চালানো হয়।”

চলতি শতকের শুরুর দিকে হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী বাংলাদেশ (হুজিবি) ছিল বাংলাদেশে সক্রিয় জঙ্গি দলগুলোর মধ্যে বেশি সক্রিয়। এর মধ্যে জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) আবির্ভাব ঘটে।

২০১৩ সালের পর জেএমবির পাশাপাশি আনসারুল্লাহ বাংলা টিম অনেক বেশি তৎপর হয়ে ওঠে, যারা পরে নাম বদলে হয় আনসার আল–ইসলাম। এ দুই দলের হাতে প্রাণ যায় মুক্তমনা লেখক, প্রকাশকসহ অনেকের। হোলি আর্টিজান হামলার জন্য দায়ী করা হয় জেএমবির নতুন একটি ধারাকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নাম দেয় নব্য জেএমবি। পরের কয়েক বছরে সাঁড়াশি অভিযানে, তাদের তৎপরতাও অনেকটা স্তিমিত হয়ে আসে।

এক প্রশ্নের জবাবে সিটিটিসি প্রধান বলেন, জঙ্গিদের ‘বীজ’ এখনো আছে। না হলে কেন নতুন সদস্য আসছে। নতুন সংগঠন হচ্ছে। তবে এসব মাথায় রেখেই ডি-রেডিকালাইজেশন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আমরা জঙ্গি দমনের পাশাপাশি দেশজুড়ে মসজিদ, স্কুল,কলেজ, মাদ্রাসা, বিভিন্ন সংগঠনসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করছি।

এলিট ফোর্স র‌্যাবও হোলি আর্টিজানের ঘটনার পর জঙ্গি দমন তৎপরতায় আলোচিত হয়। নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, গাজীপুর, ঢাকার জাহাজবাড়িসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের অভিযান চালানোর ঘটনা বড় শিরোনাম হয়। সেসব অভিযানে হোলি আর্টিজানের ‘অন্যতম পরিকল্পনাকারী’ সারোয়ার জাহানসহ বেশ কয়েকজন নিহত হন।