জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ায় আগাম নির্বাচন দিয়েছেন ঋষি সুনাক

প্রিয়দেশ ডেস্ক
2 July 2024 2:19 pm
যুক্তরাজ্যে আগাম ভোট, ক্ষমতাসীনরা পারবেন কি?

ঋষি সুনাক তার দলের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ায় পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে আগাম ভোট দিয়েছেন।

দিন দিন জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ায় দিনকয়েক আগেই যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। ৪ জুলাই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, যা প্রত্যাশিত সময়ের চেয়ে আগে। অনুমান করা হয়েছিল শরতে (অক্টোবর নাগাদ) হবে ভোট। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হলো না।

ভোটের সময়, নির্বাচনি ইস্যু-সহ একাধিক কারণে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে যুক্তরাজ্যের এই সাধারণ নির্বাচন। ভোটের ময়দানে লড়তে আসা প্রতিদ্বন্দ্বীরা আপাতত প্রচারে ব্যস্ত। ইতিমধ্যে আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে জনতার জরিপে উঠে এসেছে বিভিন্ন প্রবণতা ও ইস্যুও।

বিশ্বে দেশভেদে নির্বাচনের পদ্ধতি একেক রকম। যুক্তরাজ্যের নির্বাচন হয়ে থাকে ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতিতে। পার্লামেন্টে নতুন জনপ্রতিনিধি বেছে নিতে যুক্তরাজ্যের মানুষ ভোট দেন বিভিন্ন আসনে; নিয়ম অনুযায়ী যে প্রার্থী বেশি ভোট পাবেন, তিনিই হবেন তার আসনের আইনপ্রণেতা।

এ পদ্ধতিতে প্রত্যেক আসনে সর্বোচ্চ ভোট যিনি পাবেন, তিনিই হবেন যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের এমপি। ভোটে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা দল বা প্রার্থীর জন্য কিছুই থাকে না অর্থাৎ তারা ওই আসনে পরাজিত হয়। ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড জুড়ে থাকা ৬৫০টি নির্বাচনি আসনে এ পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ হয়।

নির্বাচনে লড়বেন ৩৪ জন বাঙালি প্রার্থীও

নির্বাচনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ৩৪ জন ব্রিটিশ নাগরিক প্রার্থী হিসাবে বিভিন্ন দলের মনোনয়নে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়ছেন। ছবি : সংগৃহীত

‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ আসলে কী

যুক্তরাজ্যের ৬৫০টি সাংবিধানিক আসনের প্রত্যেকটিতে একজন করে এমপি নির্বাচিত হন, যিনি তার এলাকার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন ওয়েস্টমিনস্টারে হাউজ অব কমন্সে।ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নিতে ‘ক্রস চিহ্ন’ এঁকে দেন ব্যালট পেপারে। যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনিই জয়ী হন।

জয় পেতে প্রদত্ত ভোটের ‘নির্দিষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা’ অর্জনের দরকার নেই। অন্য প্রার্থীর চেয়ে এগিয়ে থাকা প্রার্থীকেই জয়ী ঘোষণা করা হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয়ে থাকে ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’। ভোটে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা প্রার্থীর বিশেষত্ব কিছু নেই। তিনি এক ভোটে হারলেও তাকে পরাজিত বলেই ধরা হয়।

একইভাবে যে দলের সবচেয়ে বেশি প্রার্থী জয় পান, সে দলকেই নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। অন্য দলগুলোর চেয়ে সেই দলের বেশি এমপি বা হাউজ অব কমন্সের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে তারা সরকার গঠন করে।

বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের পার্লামেন্ট নির্বাচন ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট পদ্ধতিতে হয়। ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট পদ্ধতিতে জয়-পরাজয় নির্ধারণের পর কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তাও ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট পদ্ধতিতে নির্ধারণ হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রেও যুক্তরাজ্যের রয়েছে নিজস্ব আইন।

দলীয় প্রধানই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংসদ নেতা অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী হন। যদিও বিশ্বের অনেক দেশের নির্বাচনে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও দলীয় প্রধানই যে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তেমনটি নয়।

ভারতে দলীয় প্রধানকেই প্রধানমন্ত্রী হতে হবে, এমন নিয়ম নেই। পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগে বা পরে দল মনোনীত যে কেউ সরকারপ্রধান হতে পারেন। দলের প্রধান হওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যে দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা ঋষি সুনাক দলীয় প্রধান হওয়ার প্রতিযোগিতায় জিতে তবেই প্রধানমন্ত্রী হতে হয়েছে। এমন ব্যবস্থা সব দলের জন্যই।

যুক্তরাজ্যের সবশেষ ২০১৯ সালের নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টি ৩৬৫ আসন পেলে প্রধানমন্ত্রী হন বরিস জনসন। তার আগে ২০১০ সালের নির্বাচনে কোনো দলই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। সেসময় বেশি আসন পাওয়া কনজারভেটিভ পার্টি সরকার গঠনে লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে জোট করে।

যুক্তরাজ্যে বড় দুটি দল কনজারভেটিভ ও লেবার পার্টি উভয়েই ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতিকে সমর্থন দেয়। তারা মনে করে, এই পদ্ধতি সহজ এবং ভোটাররা সহজে বুঝতে পারে। ভোটার ও এমপির মধ্যে যোগসূত্র বা সম্পর্কও গড়ে তোলা যায়।

যেহেতু ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতিতে কোনো একটি দল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সরকার গঠনের সুযোগ পায়, তাদের সমর্থকরাও বলে থাকেন, এ প্রক্রিয়ায় দলটি তার ‘নীতি-কর্মসূচি’ কার্যকর করার সুযোগ পায়।

তবে অন্যদের যুক্তি, যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে জোটের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠনের সুযোগ থাকে, সেহেতু বিভিন্ন দলের মধ্যে এ ব্যাপারে ভেতরে ভেতরে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলে। জোট গঠনে দলগুলোর এ গোপন আলাপ হয়ে থাকে ভোটারদের চোখের আড়ালে।

তবে ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট পদ্ধতি নিয়ে যুক্তরাজ্যের ভোটারদের মধ্যে বিভক্তি বহু দিনের। ২০১১ সালে যুক্তরাজ্যে এ পদ্ধতি রাখা না রাখার প্রশ্নে গণভোট হয়। সেখানে ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতি রাখার পক্ষে ভোট দেন ৬৭ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ। আর বাতিলের পক্ষে ভোট দেন ৩২ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ।

পক্ষে-বিপক্ষে আরও কী যুক্তি

বর্তমান পদ্ধতিতে বেশিরভাগ এমপি তার এলাকায় অল্প ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় দেখা যায়, ভোটার বেশি হলেও ভোটকেন্দ্রে যায় অল্প মানুষ। আর তারা তাদের পছন্দের প্রার্থীদের যে যার মত করে ভোট দেওয়া ভোট সব প্রার্থীর ব্যালটে ভাগাভাগি হয়ে যায়।

‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ এর বিপক্ষে যারা যুক্তি দেন, তাদের ভাষ্য, “এই পদ্ধতি জনগণের ভোট দেওয়ার প্রবণতা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে পারে। কারণ তারা মনে করেন, তাদের ভোট শুধু শুধু নষ্ট হবে।”

যেমন- ভোটাররা মনে করতে পারেন, তাদের কনজারভেটিভ প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার কোনো মানে নেই; কারণ, বর্তমান লেবার প্রার্থী যিনি আছেন, আগের নির্বাচনে তার বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, যা নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবর্তনের তেমন সম্ভাবনা নেই।

ফলে নিজেদের পছন্দের হলেও ‘সম্ভাব্য পরাজিত’ প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে ভোটাররা ভিন্ন কৌশল নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে বিরোধী জনপ্রিয় প্রার্থীকে পরাজিত করতে পারেন- এমন কাউকে সমর্থন বা ভোট দিতে পারেন তারা।

একইভাবে দেশের অনেক বেশি মানুষ তাদের পছন্দের দলীয় প্রার্থীকে ভোট দিলেও পার্লামেন্টে যে দলের এমপি বেশি হয়, তারাই সরকার গঠন করে থাকে।

প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৫ সাল থেকে যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে কোনো দলই ৫০ শতাংশের বেশি ভোটে জেতেনি। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কনজারভেটিভ বা লেবারদের সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপিরা সরকার গঠন করেছে।

ছোট দলগুলোর অভিযোগ

যুক্তরাজ্যের ছোট দলগুলো দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে, ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতিতে তাদের কোনো সুবিধা হচ্ছে না। ভোটের এ প্রক্রিয়ায় বহুদলীয় গণতন্ত্র ঠিকমত প্রতিফলিত হচ্ছে না। যেমন- ২০১৯ সালে লিবারেল ডেমোক্র্যাটস (সংক্ষেপে লিব ডেম) ১১ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট পেলেও হাউস অব কমন্সে ২ শতাংশের কম আসন পায়।

ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে গ্রিন পার্টি ২ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পেলেও দলটির এমপি হন মাত্র একজন। ২০১৫ সালে ইউকেআইপি ১২ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পেলেও তাদের এমপি ছিল মাত্র একজন।

বিবিসি