মা-বাবারা তাদের শিশুদের যে রোগটি নিয়ে সবচে বেশি চিন্তা করেন সেটি হলো সর্দি-কাশি। কথাটি সাধারণ শোনালেও রোগটি মোটেও সাধারণ নয়। সর্দি এবং কাশি রোগও এক নয়। এ দুটিতে অনেক ফারাক।
শিশুর বড় হবার পথে প্রতিটি শিশুর কোনো না কোনো সময়ে কাশিতে আক্রান্ত হয়। কখনো কাশি হয়নি এমন শিশু পাওয়া যাবে না। এই কাশির অবস্থা নানা ধরনের হতে পারে। কারো কারো কাশি গভীর রাতে হয়, কারোবা হয় প্রতিদিন সকালে। কারো কারো হয় শুষ্ক কাশি আর কারোবা থুথুসহ কাশি। কাশির কারণ না জানলে চিকিৎসা করাও সহজ হয় নয়।
কী কী কারণে শিশুর কাশি হতে পারে?
শিশুর কাশি অনেক বাবা-মায়ের চিন্তার ও কষ্টের কারণ। তবে কাশির প্রথম দিকে তারা এ রোগের ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দেন না। বয়সের কারণে শিশুর শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। এ সময় তাদের শ্বাসনালী পরিপক্ক থাকে না বলে কাশিতে শ্বাসণালী প্রদাহ ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই যথা সময়ে কাশির চিকিৎসা না করালে শিশুর নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে।
অনেক অভিভাবক মনে করেন, সর্দির কারণে শিশুর কাশি হয়। এটি সত্য। তবে এটিই একমাত্র কারণ নয়। কাশির আরও অনেক কারণ আছে। সেগুলোর পার্থক্য বুঝতে না পারলে রোগ নির্ণয় ভুল হতে পারে। এতে কাশি না সেরে বরং আরও গুরুতর হতে পারে।
তাহলে কেমন করে নির্ভুলভাবে কাশির কারণ নির্ণয় করতে হবে? এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলেন, কাশি গুরুতর এবং দীর্ঘকালীন (পুরাতন) এ দু ধরনের হতে পারে। গুরুতর কাশি সাধারণত শ্বাসণালীর প্রদাহরূপে দেখা দেয়। যেমন গুরুতর গলবিল প্রদাহ, গুরুতর শ্বাসনালী প্রদাহ এবং গুরুতর ফুসফুস প্রদাহ। এ ক্ষেত্রে জ্বর ও গলা ব্যথার সাথে সাথে বাচ্চার কাশি হয়। এর চিকিত্সায় জীবাণু-প্রতিরোধী (অ্যান্টিবায়োটিক) ওষুধ ব্যবহার করা যায়। সাধারণত প্রদাহের পরের কাশি এবং কাশিজনিত হাঁপানিকে দীর্ঘকালীন বা পুরাতন কাশি বলা হয়।
ডাক্তারই হোন কিংবা অভিভাবকই হোন, তাদের জন্য নির্ভুলভাবে কাশির কারণ চিহ্নিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাশিজনিত হাঁপানির কথাই ধরা যাক। কাশি তার একমাত্র লক্ষণ এবং এ লক্ষণের বৈশিষ্ট্য বোঝার ভুলে ভুল ভুল চিকিৎসার হার বেশি। সাধারণত যাকে ভুল করে শ্বাসণালী প্রদাহ বা ফুসফুস প্রদাহ বলে নির্ণয় করা হয়।
কাশিজনিত হাঁপানি দীর্ঘকালীন বা পুরাতন কাশি। হাঁপানির শুরুতে আকস্মিক বা সাময়িক কাশি এর প্রধান লক্ষণ। সাধারণত এ ধরনের কাশি গভীর রাতে বা ভোরে হয়। শ্বাসণালী প্রদাহের পর উত্তেজক গন্ধ বা ঠাণ্ডা হাওয়া অথবা দ্রুত গতির চলাচল ও কান্নাকাটি হাঁপানির কারণ হতে পারে।
৫০ থেকে ৮০ শতাংশ কাশিজনিত হাঁপানি ”বিশেষ হাঁপানিতে” পরিবর্তিত হতে পারে। এ ধরনের কাশিকে হাঁপানির পূর্বভাস বলে মনে করা হয়। সুতরাং আগে থেকে কাশিজনিত হাঁপানি নির্ণয় ও চিকিৎসা করা হাঁপানি রোগ প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি একে ভুল করে শ্বাসপ্রণালী প্রদাহ বা ফুসফুস প্রদাহ হিসেবে নির্ণয় করে বিপুল পরিমান অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সেবন করা হয় তাহলে এটা শিশু রোগীর পক্ষে ক্ষতিকর হবে।
এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলেন, কাশি অনেক ধরনের। কাশির কারণ অস্পষ্ট হলে বারবার এবং দীর্ঘকাল ধরে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহারে বাচ্চাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে। প্লীহা ও পাকস্থলী এমন কি শরীরের অন্যান্য নালীর ক্ষতি হবে।
শিশুর কাশি সম্পর্কে অভিভাবকদের বেশ কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। অনেকে মনে করেন, তার বাচ্চার কাশি এমনি এমনি সেরে যাবে। এ ছাড়া কারণ নির্নয় ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করানোও একটি বড় ভুল।
শিশুর কাশি হলে সর্বপ্রথম থুথু নিঃসরণ করাতে হবে এবং থুথু নিঃসৃত হলে কাশি স্বাভাবিকভাবেই কমবে। শিশুরা বেশি সময় মা-বাবার সঙ্গে থাকে বলে তাদের দেখাশোনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এ সম্পর্কে চীনের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার লি বলেন, গুরুতর কাশি সেরে যাওয়ার পর সন্তানকে ভালভাবে কয়েক দিন বিশ্রামে রাখতে হবে। স্পর্শকাতর (এলার্জি) উৎস থেকে দূরে রাখতে হবে। তেলে ভাজা জিনিস কম খাওয়ানো ভাল। ঘুমাবার আধা ঘন্টা আগে সন্তানকে দুধসহ কিছুই না খাওয়ানোর পরামর্শ দিচ্ছি।
ঘুমাবার সময় যদি বাচ্চার কাশি না থামে তাহলে তার মাথা উচু করে রাখতে হবে। এভাবে কাশি প্রশমিত হতে পারে। তাছাড়া মাঝেমাঝে ঘুমাবার ভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। কখনো বাঁ কাতে আবার কখনো ডান কাতে ঘুমানো যেতে পারে। এটা শ্বাসপ্রণালী থেকে জলজ পদার্থ নিঃসরণে সহায়ক হবে। কাশিতে আক্রান্ত শিশুকে দুধ খাওয়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া উচিত নয়।
ঘরে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং ৬০-৬৫ শতাংশ আর্দ্রতার পরিবেশে শিশুর কাশি কিছু প্রশমিত করতে পারে। শিশুকে গরম পানি, দুধ ও সিদ্ধ করা চালের পানি এবং টাটকা আপেল ও নাসপতির জুস খাওয়ানো যেতে পারে।
ডাক্তারের চিকিৎসা মা-বাবার যত্নের বিকল্প হতে পারে না। ডাক্তার সব সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম নন। মা-বাবার বিজ্ঞানসম্মত যত্ন শিশুর কাশির তীব্রতা কমিয়ে আনতে পারে এবং কাশির লক্ষণ প্রশমিত করতে পারে।