মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই দেখে এসেছে আশপাশের প্রিয় মানুষগুলো একে একে মরে যাচ্ছে। একটি নির্দিষ্ট সময় পরে মানুষ আর এই সুন্দর পৃথিবীতে অবস্থান করতে পারে না। এই পৃথিবীর মায়া তাকে ছাড়তেই হয়। এ কারণেই প্রাচীন কালের রাজা-বাদশারা চাইতেন অমর হতে। এ জন্য তারা রাজকোষের প্রচুর অর্থ ঢালতেন অমরত্বের গবেষণায়। কিন্তু তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। মৃত্যু তাদের জগতের অন্যপারে নিয়ে গেছে। সেই রাজা-বাদশাদের চেষ্টা সফল না হলেও তাদের সেই চেষ্টায় অনেক কঠিন কঠিন রোগের দাওয়াই আবিস্কার করা গেছে। অমরত্বের গবেষণা না করলে হয়ত এসব চিকিৎসা পদ্ধিত আবিস্কার হতে আরও শত বছর পেরিয়ে যেতো।
এক বোতল পানির দামেই যদি পাওয়া যায় এমন একটি পিল, প্রতিদিন যেটি খেয়ে ঠেকিয়ে দেয়া যাবে আপনার বার্ধক্য, তাহলে কেমন হয়? এরকম একটি ঔষধ বা অমরত্ব-সুধা আবিস্কারের চেষ্টা চলছে বহু শত বছর ধরে।
অমরত্বের গবেষণায় হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে। তাদের এক সাম্প্রতিক গবেষণা যদি সফল হয়, তাহলে সেই স্বপ্ন খুব শীঘ্রই বাস্তবে রূপ নিতে পারে। তাদের গবেষকরা দাবি করছেন, এই বার্ধক্য-প্রতিরোধী গবেষণা সফল হলে মানুষ দেড়শো বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারবে। শরীরের বুড়িয়ে যাওয়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সেল বা কোষ ব্যবহার করে একেবারে নতুন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও তৈরি করা সম্ভব হবে। আর ২০২০ সালের মধ্যেই হয়তো এই চিকিৎসা মানুষের ওপর প্রয়োগ করা যাবে। আর খরচ? চিন্তার কোনো কারণ নেই। এক বোতল পানির দামেই মিলতে পারে এমন একটি পিল, প্রতিদিন যেটি খেয়ে ঠেকিয়ে দেওয়া যাবে নিজের বার্ধক্য! এরকম একটি ওষুধ বা অমরত্ব-সুধা আবিস্কারের চেষ্টা চলছে বহু শত বছর ধরে।
হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের এই যুগান্তকারী গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন ড. ডেভিড সিনক্লেয়ার। ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে তারা এর মধ্যে সফলও হয়েছেন। এখন চেষ্টা চলছে, বার্ধক্য প্রতিরোধী এই চিকিৎসা মানবদেহে প্রয়োগ করার।
হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল গত মার্চে তাদের সাইটে প্রথম এই গবেষণার কথা প্রকাশ করে। গবেষক দলের প্রধান ড. ডেভিড সিনক্লেয়ার সেখানে নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে এই বার্ধক্য ঠেকানোর চিকিৎসায় তারা সাফল্য দেখতে পাচ্ছেন।
“আমাদের বয়স যখন বাড়ে, তখন আমাদের শরীরের ভেতর যেসব ছোট ছোট রক্তনালী আছে, সেগুলো বুড়িয়ে যেতে থাকে এবং এ পর্যায়ে একদম শুকিয়ে যায়। ফলে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এবং পেশিকলায় রক্ত প্রবাহ অনেক কমে যায়। মানুষের শরীরের অনেক রোগ-ব্যাধির মূল কারণ কিন্তু এই রক্তনালীর বার্ধক্য। বিশেষ করে বহু ধরণের হৃদরোগ, স্নায়বিক রোগ এটা থেকেই হয়।‘’
আশার কথা হল, হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের গবেষক দল ইঁদুরের ওপর গবেষণা চালিয়ে তাদের মধ্যে এই রক্তনালীর বুড়িয়ে যাওয়া তো ঠেকিয়েছেনই, উপরন্তু সেটিকে ঘুরিয়ে দিতেও সক্ষম হয়েছেন। এই সাফল্যের মানে হচ্ছে, মানুষের অনেক ধরণের রোগ-ব্যাধির নিরাময় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
গবেষক সিনক্লেয়ার বলেন, “আমরা এই রক্তনালীর বুড়িয়ে যাওয়ার রহস্য আসলে উদঘাটন করেছি এই গবেষণায়।” এনএডি নামের একটি মলিকিউল এবং সার্ট-ওয়ান নামের একটি প্রোটিন মূলত এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করে। রক্তনালীতে এই এনএডির মূল কাজ হচ্ছে সার্ট-ওয়ান এর উপস্থিতি বাড়ানো। আর সার্ট-ওয়ান রক্তনালী এবং পেশীকলার মধ্যে সংযোগ ঘটায়। কিন্তু বয়স যত বাড়ে, রক্তনালীর মধ্যে এই এনএডি এবং সার্ট-ওয়ান, দুটিই কমতে থাকে। ফলে রক্তনালী এবং মাংসপেশির মধ্যে যোগাযোগও কমতে থাকে।
ড. সিনক্লেয়ার এবং তাঁর সহকর্মীরা ইঁদুরের ওপর যে গবেষণাটি চালিয়েছেন, সেখানে তারা এনএমএন নামের একটি রাসায়নিক যৌগ প্রয়োগ করেন ইঁদুরের দেহে। এই এনএমএন ইঁদুরের রক্তনালীতে এনএডি’র মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এর পরিণামে সার্ট-ওয়ান নামের প্রোটিনের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। ফলে ইঁদুরের রক্তনালীর এনডোফেলিয়াল সেলগুলো খুবই কর্মক্ষম থাকে। যা পেশিতে রক্তপ্রবাহ বাড়াতে সাহায্য করে।
যেসব বয়স্ক ইঁদুরের ওপর এই গবেষণা চালানো হয়, তাদের ক্ষেত্রে নাটকীয় সাফল্য পেয়েছেন গবেষকরা। তাদের শারীরিক সক্ষমতা ৮০ শতাংশ বেড়ে গেছে।
ড. সিনক্লেয়ার বলছেন, যারা এখন বার্ধক্যের কারণে আর শরীরচর্চা করতে পারেন না, বা চলাফেরা করতে পারেন না, তাদের জন্য এই গবেষণা এক বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। এবং সেটি ২০২০ সালের আগেই।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, রক্তনালীর ভেতরে রক্ত চলাচল বাড়ানোর জন্য নতুন ধরনের ওষুধ আবিস্কারও সম্ভব হবে এই গবেষণার ভিত্তিতে।
অমরত্বের সন্ধ্যানে: জীবনটা বেশ ছোট। মাঝে মাঝেই মনে হয়, এই তো সেদিন ছোট ছিলাম, আজ তরুণ বয়সে এসে দাঁড়িয়েছি। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে আর কিছুদিন পরেই মাঝবয়সে গিয়ে দাঁড়াবো। এরপর শেষ বয়স থেকে হুট করে জীবনাবসান! যেন চোখের পলকেই ঘটে গেলো সবকিছু। এজন্য মানুষ সবসময়ই চেয়েছে অমর হতে। সৃজনশীল মানুষেরা তাদের সৃজনশীল কাজকর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের ভালোবাসায় অমর হয়ে আছেন। ইতিহাসের খলনায়কেরা তাদের হীন কাজকর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের ঘৃণার মাঝে অমর হয়ে আছে।
তবে কিছু কিছু মানুষ ছিলেন যারা আসলে কাজকর্মের মধ্য দিয়ে অমর হওয়ায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তারা একেবারে দৈহিকভাবেই অমর হতে চাইতেন। অর্থাৎ তাদের স্বপ্ন ছিলো শত শত বছর বেঁচে থাকা, পৃথিবী ধ্বংসের আগপর্যন্ত পৃথিবীর বুকে টিকে থাকা। এমন অমরত্ব সন্ধানী মানুষেরা তাই অমর হতে গিয়ে বেছে নিয়েছিলেন উদ্ভট বিভিন্ন পদ্ধতি।
অমরত্বের সন্ধানে মাশরুমের দ্বারস্থ হবার ব্যাপারে চীনারা অনেক গবেষণা করেছেন। তাদের রসায়নবিদরা শত শত বছর কাটিয়ে দিয়েছেন এর পেছনে। তাদের সম্রাটগণ ছিলেন এ সংক্রান্ত গবেষণার সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক। এদের মধ্যে বড় পন্ধা ছিল লিং ঝি নামের ঔষধি মাশরুম।
ঋগ্বেদে উল্লেখ্য আছে অমৃতের কথা। এটি এমন একটি পানীয় যা খেলে মানুষ অমরত্ব লাভ করতে সক্ষম। সনাতন ধর্মসহ অন্যান্য আরো সংস্কৃতিতে একে ‘সোমা’ নামেও উল্লেখ করা হয়েছে। স্বর্গের দেবতা ইন্দ্র এবং অনলের দেবতা অগ্নিও অমৃত পান করেছিলেন বলে উল্লেখ আছে ঋগ্বেদে। এরপর তারা বলেছিলেন: We have drunk Soma and become immortal; we have attained the light, the Gods discovered. Now what may foeman’s malice do to harm us? What, O Immortal, mortal man’s deception?” (Rigveda 8.48.3).
‘অমরত্ব’ চার অক্ষরের ছোট্ট একটি শব্দ; কিন্তু এখনো পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের মনে শব্দটি বড় আশাবাদের ব্যাঞ্জনার সৃষ্টি করে। কে চায় সুন্দর এই পৃথিবী থেকে আগেভাগে বিদায় নিতে? অতীতের নানান মিথলজিতে আমরা দেখি নানা রকম ‘শর্ত প্রযোজ্য’ ও ‘নিঃশর্ত’ অমরত্বের কথা। রয়েছে অমরত্বের সাথে তথাকথিত শয়তানের যোগসাজশের কথা, আরো কত কী!
এখানে সেসব মিথলজি নয়, বরং অদূর অতীতে দুরারোগ্য ব্যাধিকে নিয়ন্ত্রণে এনে এককালের ‘অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু’কে বধ করার ইতিহাস এবং বর্তমান বিজ্ঞান, বিশেষ করে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে উন্নত কম্পিউটার প্রযুক্তি ও অত্যাধুনিক ন্যানো-টেকনোলজির মিশ্রণে বিজ্ঞান গবেষণা বর্তমান মরণশীল মানুষকে কিভাবে সুদূর ভবিষ্যতে অমরত্বের দিকে নিয়ে যাচ্ছে সে সম্পর্কে আধুনিক বিজ্ঞান ও গবেষণার নানা তথ্য তুলে ধরা হচ্ছে।
যত গবেষণা
অমরত্ব লাভের নেশায় বুঁদ করপোরেট কোম্পানিগুলোও। সারাবিশ্ব থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়া হচ্ছে অমরত্ব লাভের গবেষণায়। আর সারাবিশ্বের বাঘা বাঘা সব বিজ্ঞানিরাও যৌথভাবে অবদান রাখছেন এসব গবেষণায়। তাছাড়া তারকাখ্যাতি পাওয়া ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোও এসব গবেষণার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। এরমধ্যে অন্যতম হলেন-
ল্যারি এলিসন:
ল্যারি হলেন পৃথিবীর সেরা পাঁচ ধনীদের মধ্যে একজন এবং ওরাকল কর্পোরেশনের মালিক।
সের্গেই ব্রিন:
মিস্টার ব্রিন হলেন গুগলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ক্যালিকো ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা। এই প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য সুস্বাস্থ্য, সমৃদ্ধি ও দীর্ঘায়ু লাভে সহযোগিতা করা।
আউরো ডি গ্রে:
একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও গবেষক, তিনি পুনরুজ্জীবনী ওষুধের ওপর অনেক গবেষণার প্রতিষ্ঠাতা।
এরা স্বীকার করেছেন যে, তারা বার্ধক্য ও মৃত্যুকে প্রচণ্ড ভয় পান। তাই তারা গবেষণা করছেন পাশাপাশি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যায় করছেন অমরত্ব লাভ করার বিভিন্ন প্রকল্পে। তারা আশা দেখছেন, তাদের প্রকল্পগুলো সফল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে প্রবল।
বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ ও ওঝারা সবসময়ই অমৃত গাছের সন্ধান করেছেন। তাদের অনেকের মতে, এটি হতে পারে সাইবেরিয়ার ওঝাদের ব্যবহৃত Fly Agaric (Amanita Muscaria) নামের একটি হালকা হ্যালুসিনোজেনিক (বাস্তবতা সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী) মাশরুম। এন্থোবোটানিস্ট টেরেন্স ম্যাককেনার মতে, এই অমৃত হতে পারে Psilocybe Cubensis নামের একটি হ্যালুসিনোজেনিক মাশরুম যা গরুর গোবরে জন্মে থাকে। এই মাশরুমটিই সনাতন ধর্মে গরুর এত উচ্চ মর্যাদার জন্য দায়ী।
দীর্ঘ জীবন লাভের জন্য তরল ধাতু পানের মতো বিচিত্র প্রথা চীন থেকে শুরু করে মেসোপটেমিয়া হয়ে একেবারে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। তৎকালে বিশ্বাস প্রচলিত ছিলো যে, আপনি যা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করবেন, সেটির বৈশিষ্ট্য আপনার শরীরের মাঝেও প্রতিফলিত হবে। যেহেতু ধাতব পদার্থগুলো সাধারণত বেশ শক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে, তাই লোকে মনে করতো এর তরল রুপটি পেটে চালান করলে বুঝি ধাতুর মতোই দীর্ঘস্থায়ী হবে তাদের নশ্বর শরীরটি। অর্থাৎ নশ্বর দেহকে অবিশ্বর করতেই তারা বেছে নিয়েছিলো বিভিন্ন ধাতুর তরলীকৃত রুপ গলধকরণকে।
পরশ পাথর ও অমরত্ব সুধা নিয়েও নানা গবেষণা ছিল প্রাচীণকালে। মানুষের সেই অক্লান্ত প্রচেষ্টা এখনো এই একবিংশ শতাব্দেীতেও এসে এতটুকুও ভাটা পড়েনি। যারই ফলশ্রুতি, বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগামী ২০২০ সালের মধ্যে অমরত্বের বিষয়ে বড় একটি সুসংবাদ দিতে পারবেন তারা। তবে ২০৪১ সালে মিলবে আরও বড় চমক।
সূত্র: বিবিসি, সিএনএন, রয়টার্স, নিউইয়র্ক টাইমস