ডিম নিয়ে ডামাডোল

নিজস্ব প্রতিবেদক
16 October 2024 12:23 am
কাঁচাবাজারে চলছে অরাজকতা। একেকবার একেকটি নিত্যপণ্য নিয়ে বাজার অস্থির হচ্ছে। এবার ডিম নিয়ে হচ্ছে ডামাডোল।

কাঁচাবাজারে চলছে অরাজকতা। একেকবার একেকটি নিত্যপণ্য নিয়ে বাজার অস্থির হচ্ছে। এবার ডিম নিয়ে হচ্ছে ডামাডোল।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরও নিত্যপণ্যের সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব হয়নি। কাঁচাবাজারে চলছে অরাজকতা। একেকবার একেকটি নিত্যপণ্য নিয়ে বাজার অস্থির হচ্ছে। এবার ডিম নিয়ে হচ্ছে ডামাডোল। নিরুপায় হয়ে সরকারের উপদেষ্টারা দিচ্ছেন এলোমেলো বক্তব্য। অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ যেমন সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন করে বলেছেন, ডিম কি আমি মেশিন দিয়ে তৈরি করব?

ডিমের দাম সহনীয় করতে সরকারি পরামর্শে চলতি সপ্তাহে কৃষি বিপণন অধিদফতর দাম বেঁধে দিয়েছে ফার্মের মুরগির ডিম এবং ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির। কৃষি অধিদফতর দাম বেঁধে দেয়ার আগে যৌক্তিক দাম নিয়ে পোল্ট্রি খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নানামুখী আলোচনা হয়েছে।

সর্বসম্মতিক্রমে ২০২৪ সালের জন্য বাজারে খুচরা পর্যায়ে ব্রয়লারের দাম ১৭৯ টাকা ৫৯ পয়সা, সোনালি মুরগির দাম ২৬৯ টাকা ৬৪ পয়সা এবং প্রতি পিস ডিমের দাম ১১ টাকা ৮৭ পয়সা করে ডজন ১৪২ টাকা ৪৪ পয়সা বেঁধে দেয়া হয়েছে। রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) ডিম-মুরগির দাম বেঁধে দেয়া হলেও টানা এ কয়দিন সরেজমিনে বাজার ঘুরে সবশেষ বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) দেখা যায়, বেশিরভাগ বাজারেই খুচরা পর্যায়ে মানা হচ্ছে না সরকারের বেঁধে দেয়া দাম।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর, রামপুরা, বাড্ডা, নতুনবাজার, ভাটারা এসব বাজারে এখনো ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১৮৫-১৯০ টাকায়। সোনালি বিক্রি হচ্ছে ২৭০-২৮০ টাকায় এবং প্রতি ডজন ডিমের দাম এখনও ১৬০-১৬৫ টাকা।

কেন সরকারের নির্ধারিত দামে ডিম-মুরগি বিক্রি করছেন না জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর টাউন হলের ডিম বিক্রেতারা জানান, সরকার উৎপাদন পর্যায়ে ডিমের দাম ১০ টাকা ৫৮ পয়সা এবং পাইকারি পর্যায়ে ১১ টাকা শূন্য ১ পয়সা ঠিক করে দিলেও, তাদের কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। প্রতিটি ডিম ১২ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে।

রাজধানীর উত্তর বাড্ডা কাঁচাবাজারেও একই অবস্থা। বাজার ঘুরে দেখা যায়, ফার্মের মুরগির বাদামি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ টাকা ডজন এবং সাদা ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা ডজন করে।

বাজার করতে আসা করপোরেট চাকরিজীবী মনির হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ডিমের ডজন হওয়ার কথা ১৪২ টাকা, সেটা ১৪৫ টাকা রাখলেও মানা যায়। কিন্তু বেঁধে দেয়া দামের থেকে ডজনে ২০ টাকা বেশি রাখা কোনোভাবেই যৌক্তিক না। সরকার অবশ্যই ব্যবসায়ীদের লাভ নিশ্চিত করেই দাম বেঁধে দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা মুনাফা হবে না বলে যে মায়াকান্না করছেন তার কোনো ভিত্তি নেই।’

হিসাব করে দেখা যায়, ডিম বিক্রেতাদের কথামতো প্রতিটি ডিমের দাম ১২ টাকা ধরা হলেও খুচরা পর্যায়ে ১৬০ টাকা ডজন ধরে প্রতি পিস ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩ টাকা ৩৩ পয়সায়। এতে করে একটি ডিমে খুচরা পর্যায়ে বিক্রেতাদের লাভ থাকছে ১ টাকা ৩৩ পয়সা। আর ডজনপ্রতি ডিম বিক্রি করে ব্যবসায়ীরা লাভ করছেন ১৬ টাকা করে- যা এক রকমের অযৌক্তিক।

এলাকার মুদির দোকানদাররা যুক্তি দিচ্ছেন, পাইকারদের থেকে বেশি দামে ডিম কিনতে হচ্ছে। এদিকে পাইকারদের যুক্তি, খামারিরা বেশি দামে বিক্রি করছে। খামারিদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারা ১০ টাকা ৫০ পয়সা করেই ডিম বিক্রি করছেন পাইকারদের কাছে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কাদের কারসাজিতে অস্থির হচ্ছে ডিমের বাজার?

সময় সংবাদকে সঙ্গে নিয়ে এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মোহাম্মদপুর টাউন হলে অভিযান চালায় জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। অভিযানে উঠে আসে পাইকারি বিক্রেতাদের ডিম বিক্রির নানা অনিয়ম। খামারিদের থেকে কম দামে ডিম কিনলেও, প্রমাণস্বরূপ কোনো পাকা রসিদ রাখেন না তারা। বারবার ভোক্তা অধিকার নির্দেশনা দেয়ার পরেও পাকা রসিদ না রাখায় সহজেই বোঝা যায়, কারসাজির মূল হোতাদের বড় অংশ এই পাইকারি বিক্রেতারা।

এ ব্যাপারে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মণ্ডল বলেছেন, ব্যবসায়ীদের পাকা রসিদ রাখতে বলা হলেও তারা কথা শুনছেন না। এদিকে প্রতি পিস ডিমে ১ টাকা করে লাভ করা যৌক্তিক না। যে যুক্তি দিয়ে ব্যবসায়ীরা দাম কমাচ্ছেন না, তাদের মুনাফার হিসাব দেখলে সেটি টেকে না।

একই দশা মুরগির বাজারেও। বিশেষ করে ব্রয়লার মুরগি নিয়ে কারসাজি পৌঁছেছে চরমে। মোহাম্মাদপুর টাউনহল কাঁচা বাজারে সবচেয়ে বড় পাইকারি ব্রয়লার দোকান নিউ প্যারাডাইস ব্রয়লার হাউজে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মূল্য তালিকায় ব্রয়লারের দাম ১৮০ টাকা লেখা থাকলেও ক্যাশ মেমোতে বিক্রিমূল্য লেখা ১৮৫ টাকা। উৎপাদক পর্যায়ে পাইকারি এ দোকানটির মালিক মুহাম্মদ ইব্রাহিম কেজিপ্রতি ব্রয়লার কিনেছেন ১৬৪ টাকা করে। অর্থাৎ প্রতিকেজি ব্রয়লারে ইব্রাহিম লাভ করছেন ২১ টাকা করে।

ভোক্তা অধিকারকে সঙ্গে নিয়ে খোঁজ করে জানা যায়, মোহাম্মদপুর বাজারে ব্রয়লারের বড় সরবরাহ আসে এই দোকান থেকে। মুরগি সরবরাহ দিলেও সঙ্গে কোনো ক্যাশ মেমো দেন না দোকান মালিক। এতে করে ধোঁয়াশা থেকে যায় ক্রয়মূল্য এবং বিক্রয়মূল্যের হেরফেরে।

জব্বার মণ্ডল বলেন, বড় বড় এসব পাইকারি দোকানের মালিকদের অনেকেরই নিজেদের পোল্ট্রি খামার আছে। এরা নিজেদের মুরগি নিজেরা কিনে নিজেরাই আবার খেয়াল খুশিমতো দাম ঠিক করে ইচ্ছামতো মুনাফা করেন। এদের হাত ধরেই কাঁচাবাজারগুলোতে অস্থিরতা বিরাজ করে।

খামার পর্যায়ে সরকারের নির্ধারিত দামে মুরগি বিক্রি হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে জব্বার বলেন, শিগগিরই এ ব্যাপারে তদন্ত শুরু করবে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। কোনাভবেই যেন নিজেদের খেয়ালখুশিমতো দামে ব্যবসায়ীরা ডিম-মুরগি বিক্রি করতে না পারেন সেজন্য অভিযান চলমান থাকবে। আশা করা যায়, দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিটি বাজারে সরকারের নির্ধারিত দামে ডিম-মুরগি বিক্রি হবে।

ভোক্তাদের পক্ষ থেকে সম্প্রতি কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, অসাধু মজুতদারীদের সিন্ডিকেট না ভাঙতে পারলে দাম বেঁধে দিয়ে কখনোই বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আর বাজারে যে দামে বিক্রি হচ্ছে তার চেয়ে বেশি দাম নির্ধারণ করে দিলে অসাধু ব্যবসায়ীরা এর সুযোগ নিবে। অন্যদিকে প্রাণিসম্পদ ও কৃষি বিপণন অধিদফতর শুধুমাত্র দাম নির্ধারণ করে বাজার তদারকি না করলে বাজার আরও অস্থির হয়ে উঠবে এবং করপোরেট গ্রুপগুলো এ সুযোগে আবারও আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠতে পারে।

ক্যাব বলছে, ‘সরকারের দফতরে বড় বড় করপোরেট গ্রুপগুলোকে সুযোগ করে দেয়ার কারণে সরকারের উদ্যোগের সুফল প্রান্তিক পর্যায়ে পাওয়া যাবে না। দাম নির্ধারণ বা যেকোনো সংকট হলে শুধুমাত্র এ খাতের বড় করপোরেট গ্রুপগুলোকেই ডাকা হয়। প্রান্তিক, ছোট ব্যবসায়ী ও খামারিদের ডাকা হয় না।’ দাম নির্ধারণ বা যেকোনো সংকট সমাধানে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, প্রান্তিক খামারি, ভোক্তা, ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে ক্যাব।

সরকারি দফতরগুলো দাম নির্ধারণের সময় বাজার থেকে পর্যাপ্ত তথ্য না নিয়ে যাচাই-বাছাই ছাড়াই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন। সরকার পরিবর্তন হলেও বিগত সরকারগুলোর আমলের দাম নির্ধারণের প্রচলিত পদ্ধতিটা অনুসরণ করেই সিদ্ধান্ত নেবার কারণে কোনো সুফল আসছে না বলে দাবি ক্যাবের।

শুধুমাত্র বাজারে দাম নির্ধারণ করে দিলেই হবে না, বাজারে সংশ্লিষ্ট রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়মিত বাজার তদারকি ও আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বাজারে সিন্ডিকেট ভাঙতে প্রয়োজনে বাজার তদারকির পাশাপাশি উৎপাদন খরচ কমিয়ে স্থানীয়ভাবে সরবরাহ বাড়াতে উদ্যোগী হতে হবে জানায় সংগঠনটি।

সরকারে ভুল সিদ্ধান্তে বেড়েছে ডিমের দাম

ডিমের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ‘সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত’ এবং ‘সিন্ডিকেটকে’ দায়ী করছে বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন।

সংগঠনটির সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, “ডিমের দাম নির্ধারণ করা হলো। কিন্তু বাজারের চাহিদার ৮০ পারসেন্ট উৎপাদনকারী প্রান্তিক খামারীদের রাখা হয়নি”।

দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘বাজার মেকানিজম না জেনেই কর্পোরেটদের দিক নির্দেশনায় এই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে’ আর এর মাধ্যমে ‘কর্পোরেট গ্রুপগুলোকে সিন্ডিকেট করার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে’ বলেও মন্তব্য করে তিনি।

ডিমের কোনো সংকট নেই। ডিম আগে যা উৎপাদন হয়েছে এখন তারচেয়ে ২০ লাখ ডিম উৎপাদন কম হচ্ছে কিন্তু তাতেও চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন আছে, বলেন তিনি।

সিন্ডিকেটের কারা করছে এমন প্রশ্নের জবাবে মি. হাওলাদার বলেন, “তেজগাঁও সমিতির দামকে সারা বাংলাদেশ ফলো করে, কর্পোরেট কোম্পানির দাম ফলো করে। অর্থাৎ দাম ঠিক করতে হবে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে”।

তবে ‘সিন্ডিকেট করার’ দাবি একেবারেই খারিজ করে দিয়েছেন তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আমান উল্লাহ। বলেন, “দুই-চার-পাঁচজনের হলে হয়, লক্ষ লক্ষ মানুষের সিন্ডিকেট হয় না”।

তিনি জানান, বন্যার কারণে ডিমের সরবরাহ কমে যাওয়ায় বেড়েছে ডিমের দাম।

যেই হিসেবে চাহিদা, সেই হিসাবে উৎপাদন নাই। উৎপাদন কম। তাছাড়া বন্যার কারণে অনেকগুলা ফার্ম মাইর খাইয়া গেছে, আবার বর্ষাকালে শাক-সবজি আমদানি কম। সবমিলিয়ে যে পরিমাণ ডিম উৎপাদন না থাকার কারণেই ডিমের দাম বাড়ছে।

কাঁচামাল দুই-তিনের বেশি রাখা যায় না, উল্লেখ করে পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের দাবি ‘ভুল’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তবে এর আগে বাংলাদেশে ডিম মজুত করার ঘটনাও দেখা গেছে। গত মে মাসে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডিমের দাম ডজন প্রতি ২৫ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। সেসময় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে ডিম মজুদ করার দুইটি বড় চালান পায়।

তখন গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেছিলেন, “সাধারণত ডিম হিমাগারে সংরক্ষণ করা যায় না। অসৎ উদ্দেশ্যই এটা করা হয়। ডিম মজুদের মূল উদ্দেশ্যে হচ্ছে বাজারে সাপ্লাই কমার পর তা দাম বাড়িয়ে বিক্রি করে ব্যবসা করা।”

”এত পরিমাণ ডিম মজুদ করাই হয়েছে এই উদ্দেশ্যে। বিভিন্ন জায়গায় নামে -বেনামে মজুদের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে, বিদ্যমান আইনে ডিম হিমাগারে সংরক্ষণ করা হলে সরাসরি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না”।