ভারতের রাজস্থানে যোধপুরে আবারও জ্বলে উঠেছে সাম্প্রদায়িক আগুন। বহুল আলোচিত এই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাস অনেক পুরনো। ফলে ‘পান থেকে চুন খসলেই’ জ্বলে উঠে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন। সাম্প্রতিক সময়েও ফের শুরু হয়েছে উত্তপ্ত পরিস্থিতি। লাগানো হচ্ছে মানুষের ঘরবাড়িতে আগুন।
যেমনটা যোধপুরের বাসিন্দা ৪৭ বছর বয়সী মুহাম্মদ রইস বলছিলেন, ‘আমি ভীষণ চিন্তায় রয়েছি। এতটাই চিন্তায় রয়েছি যে আমার বাপ-দাদার ভিটে বিক্রি করে এখান থেকে চলে যেতে হচ্ছে। আমার ছোট ছোট সন্তান আছে। প্রতিবার আমাদের বাড়িকেই নিশানা বানানো হয়। এবারও তাই করা হলো।’ কথাগুলো বলতে বলতে অঝোরে কাঁদছিলেন রইস।
রইস বলে চলেন, আমি শেষ হয়ে গেছি। ডিসেম্বর মাসে আমার মেয়ের বিয়ের কথা। একটু একটু করে সমস্ত জিনিসপত্র একত্র করছিলাম। সেই সবও নিয়ে চলে গেছে হামলাকারীরা।
যোধপুরের সুরসাগরে কয়েক দশকের পুরনো দোতলা বাড়ি রয়েছে মুহাম্মদ রইসের পরিবারের। তাদের ওই ভবনটির ‘শিফা বিল্ডিং’। ওই এলাকার ল্যান্ডমার্ক হিসাবে পরিচিতি আছে ‘শিফা বিল্ডিং’ এর।
কিন্তু দিনকয়েক আগে একটা ঘটনাকে ঘিরে উত্তেজনা বাড়ার পর পাথর ছোঁড়া আর অগ্নিসংযোগের ফলে বাড়িটির বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ঘটনার পর থেকে রইসরা বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র থাকছেন। বাড়িটির বাচ্চারা এখনও ছোট। আজকাল ভয় তাড়া করে তাদের, বলেছেন মুহাম্মদ রইস।
প্রসঙ্গত, শুক্রবার রাজস্থানের যোধপুর জেলার সুরসাগর থানা এলাকায় একটা ঘটনাকে ঘিরে ঝামেলা সাম্প্রদায়িক বিবাদের রূপ নেয়। এতে হিন্দু ও মুসলিম উভয় পক্ষের লোকজন আহত হয়েছে এবং ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে দুপক্ষেরই।
সেই ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পর রবিবার সুরসাগর থানায় বিক্ষোভ দেখান কয়েকজন মুসলিম নারী। এলাকায় এখনও উত্তেজনা রয়েছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্কও রয়েছে।
কী ঘটেছিল?
গত ২১শে জুন সুরসাগর থানা এলাকায় একটা সামান্য বিবাদ হঠাৎই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার রূপ নেয় বলে অভিযোগ। পুলিশি হস্তক্ষেপে একবার বিবাদের নিষ্পত্তি হলেও পরে গভীর রাতে পাথর ছোঁড়া এবং অগ্নিসংযোগের কারণে বহু মানুষ আহত হয়েছে।
উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাঠিচার্জ করে ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোঁড়ে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে একাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। গ্রেফতারও করা হয়েছে কয়েকজনকে।
সুরসাগরের ব্যবসায়ী মহল্লার বাসিন্দা আসিফ খান পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। সাংবাদিকদের সঙ্গে ফোনে কথোপকথনের সময় তিনি বলেন, “প্রধান সড়কে একটা ঈদগাহ রয়েছে, যার গেট সরানোকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের কথা চলতে থাকে এবং ক্রমশ বিবাদ বাড়তে থাকে। তবে সন্ধ্যে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে এই বিষয়ে সবাই একটা সমঝোতায় পৌঁছায়। কিন্তু সেই সমঝোতা হওয়ার পর লোকজন তাদের বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই দু’দিক থেকে পাথর ছোঁড়া শুরু হয়। এরপরই এই ঘটনা বড় আকার নেয়।
যোধপুরের পুলিশ কমিশনার রাজেন্দ্র সিং এই ঘটনাকে ‘আকস্মিক’ বলে বর্ণনা করেছেন।
এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিতে গিয়ে সুরসাগর থানার ইনচার্জ মঙ্গি লাল ফোনে বলেন, সুরসাগর মেন রোডে অবস্থিত ঈদগাহের মূল ফটকের কাছে একটা গাছ আছে। তার কাছেই ভৈরবজির মন্দির। শুক্রবার ঈদগাহ থেকে সড়কের পূর্ব পাশে দুটো গেট তৈরি করা হয়। এরপর সেখানে লোকজন জড়ো হতে থাকে।
পুলিশ জানায়, “আমরা থানায় ডেকে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা করাই, যেখানে স্থির হয়েছিল পূর্ব দিকের গেট খোলা হবে না এবং ভৈরব মন্দিরে নির্মাণ কাজ হবে না। এই সমঝোতার পর দুই পক্ষের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হয় যা পরে পাথর ছোঁড়াছুঁড়ির আকার নেয়। সেখান থেকেই বিবাদটা বড় হয়ে ওঠে।”
দুই নাবালকের মধ্যেও বিবাদ?
ওই এলাকায় অন্য একটি বিবাদের কথা প্রকাশ্যে এসেছে। স্থানীয় বাসিন্দা হরি দেওরা বলেন, বজরং দলের সঙ্গে যুক্ত এক অল্পবয়সী ছেলে এই এলাকায় তার মামার বাড়িতে থাকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্মীয় ছবি পোস্ট করেছিল ওই নাবালক। এরপর কয়েকজন মুসলিম ছেলে ওকে বাধা দেয়। জানতে চায় ওই ছবি কেন আপলোড করেছে সে। ছেলেগুলো ওই নাবালককে মারধরও করে। পরে দু’পক্ষ থেকেই এফআইআর দায়ের করা হয়। এই বিবাদও কিন্তু সে সময় চলছিল। সোমবার ঈদের দিন দু’জন নাবালকের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল। বিষয়টা নিয়ে কয়েকদিন গোলমাল চলে।
যোধপুর পশ্চিমের ডিসিপি রাজেশ যাদব অবশ্য বলেন, “দুটো ছেলের মধ্যে ঝগড়াটা একটা ছোট ঘটনা ছিল। মূল ঘটনা ঘটেছে শুক্রবার, তারপরই এই বিবাদের সূত্রপাত হয়।”
এখন পরিস্থিতি কেমন?
সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পর থেকেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে যোধপুর পুলিশ প্রস্তুত বলে মনে করা হচ্ছে। সুরসাগরে সাম্প্রতিক ঘটনার পর শনিবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে আশপাশের পাঁচটা থানার আওতায় থাকা এলাকাগুলোয় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।
শনিবার ও রোববার রাস্তাঘাটে খুব কম মানুষকেই দেখা গিয়েছে। এলাকার অধিকাংশ বাজার ও দোকানপাটও বন্ধ ছিল। রাস্তায় টহল দিচ্ছে পুলিশের গাড়ি।
আসিফ খান বলেন, “উত্তেজনা এখনও রয়েছে। মানুষ বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে না। ঘটনায় যাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাদের অভিযোগও দায়ের করতে বলছে পুলিশ। কিন্তু মানুষ এতটাই আতঙ্কিত যে কেউ অভিযোগ পর্যন্ত দায়ের করেনি।”
“একদিকে বাড়ির পুরুষরা থানার লকআপে আছে। তাদের পরিবারের অনেকে জখম হয়েছে। এই অবস্থায় নারীরা কোথায় যাবে অভিযোগ দায়ের করতে?”
এলাকার বর্তমান পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন মি. খান। জানিয়েছেন, দুই সম্প্রদায়ের মানুষই আতঙ্কিত হয়ে রয়েছে।
তার কথায়, “এসটিএফ, আরপিএফ এবং পুলিশ রয়েছে। কিন্তু দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই ভয় কাজ করছে। বাজার বন্ধ, শিশুরা কাঁদছে, রোগীরা বাইরে আসতে চাইছে না।”
যোধপুর পশ্চিমের ডিসিপি রাজেশ যাদবকে ঘটনার পর এলাকার বর্তমান পরিস্থিতির কথা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “পরিস্থিতি এখন শান্তিপূর্ণ। পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।”
পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া এবং পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত পাঁচটা থানা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত ৪৪ জনকে গ্রেফতার ও পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে।
ওই এলাকারী বাসিন্দা জিতেন্দ্র শঙ্খলার বোন লাজবন্তী গেহলোত গুরুতর জখম হয়েছেন পাথরের আঘাতে। এক চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন ওই নারী।
ডিসিপি রাজেশ যাদবের কথায়, “বাইকে বা গাড়ি করে যারা যাতায়াত করছে তাদের উপর কড়া নজর রেখেছে পুলিশ। সর্বত্র ব্যারিকেডও রয়েছে।”
লাজবন্তী গেহলোত বলেন, “সেদিন প্রচুর পাথর ও কাঁচের বোতল ছোঁড়া হয়েছিল। প্রচুর পাথর এসে পড়েছে।”
“এখন পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে এবং লোকজনও খুব কমই রাস্তায় বেরোচ্ছে, তাই শান্তি রয়েছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে ভয় রয়েছে। ”
আসিফ খান বলেন, “এই ঘটনায় মানুষ খুবই চিন্তিত। অনেককে অবৈধভাবে আটকে রাখা হয়েছে, ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।এর মধ্যে পাঁচজন নাবালকও রয়েছে। তাদের মারধর করা হয়েছে। অনেকের হাত-পা ভেঙেছে এবং একজন যুবক এখনও এমজি হাসপাতালে ভর্তি।”
তিনি আরও বলেন, “এমন অনেকে আছেন যাদের শনিবার প্রাথমিক চিকিৎসার পর,আর যাদের হাড় ভেঙেছে তাদের প্লাস্টারের পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।”
ঘটনার পর বাড়ি ছাড়া মুহাম্মদ রইস
সুরসাগরের ‘শিফা বিল্ডিং’ বহু বছর ধরেই ওই এলাকার একটা স্বীকৃত ল্যান্ডমার্ক। শুক্রবার রাতে অগ্নিসংযোগে ফলে ওই ভবনে স্থিত একটা দোকানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পুড়ে গিয়েছে লক্ষাধিক টাকার জিনিস।
‘শিফা বিল্ডিং’ মুহাম্মদ রইসদের পৈতৃক বাড়ি। কিন্তু এলাকায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পর থেকেই চরম আতঙ্কে রয়েছেন তিনি। ঘটনার পর থেকে বাড়িছাড়া তার পরিবার।
‘শিফা বিল্ডিং’ থেকে কিছুটা দূরে একটা ভাড়া করা বাড়িতে আপাতত থাকছেন তারা।
পাথর ছোঁড়া আর অগ্নিসংযোগের সময়কার পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে মি. রইস বলেন, “আমরা তখন ঘুমাচ্ছিলাম, হঠাৎ পাথর ছোঁড়া শুরু হল। বাইরে থেকে শব্দ আসছিল।”
“দেখলাম কিছু লোক লাঠি-রড দিয়ে দোকানের শাটার ভেঙে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। দোকানে ঝাড়ু তৈরির জিনিসপত্র মজুত ছিল। স্থানীয় এক ব্যক্তিকে ওই দোকানঘর ভাড়া দেওয়া হয়েছিল।”
ঘটনায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে দোকান মালিকের। ক্ষতি হয়েছে ‘শিফা বিল্ডিং’-এর বাসিন্দা মি. রইস ও তার ভাইয়ের।
রইস বলেন, “দোকানে রাখা অন্তত ১৫ লক্ষ টাকার জিনিস পুড়ে গেছে। আমাদের বাড়ির জানালাগুলো সব ভেঙে গিয়েছে। পাথর ও কাঁচের বোতল ছুঁড়ে হামলা চালানো হয়েছিল।”
“ওই বাড়িতে পরিবার-সহ আমরা দুই ভাই থাকি। ঘটনার পর থেকে পরিবারের নারী ও শিশুরা আতঙ্কিত হয়ে রয়েছে। আমরা তো কখনও কারও প্রতি অন্যায় করিনি, তাহলে আমাদের সঙ্গে কেন এমনটা হল?”, কথা বলতে বলতে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, “ঘটনার সময় আমার ভাইপো পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে তার গাড়ি বের করতে গিয়েছিল। কিন্তু প্রশাসনের লোকজন তাকে গাড়িতে রেখেই চলে আসে। কোনও মতে গাড়ি ফেলে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে এসেছে ছেলেটা, নয়তো ওকে মেরেই ফেলত!”
থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন মি. রইস। তিনি বলেন, “আমি এফআইআর দায়ের করেছি। গতবার (২০০৮ সালে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সময়) আমার মোটরসাইকেল পুড়ে গিয়েছিল, এখনও তার জন্য কোনও ক্ষতিপূরণ পাইনি।”
ঘটনার সময় ছোঁড়া পাথরের আঘাতে একটা চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন ৫২ বছরের লাজবন্তী গেহলোত। তিনি বলেন, ‘গতকাল আমার চোখে অস্ত্রোপচার হয়েছে। আজ হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছি। ডাক্তার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, চিকিৎসক জানিয়েছেন আমি দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছি।”
“এখন একমাত্র কোনও চমৎকার হলে আমি আবার ওই চোখে দেখতে পাব।”
ঘটনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তখন রাত প্রায় ন’টা বাজে, বাইরে শব্দ হচ্ছিল। সেই সময় আমার নাতি বাইরে খেলছিল। ওকে নিতে গিয়ে দেখি পাথর ছোঁড়া হচ্ছে। হটাৎ একটা পাথর এসে আমার চোখে লাগল। নাতিকে নিয়ে কোনও মতে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম।”
“আমার জামাকাপড় আর মুখ রক্তে ভিজে গিয়েছিল। আমার সন্তানরা কোনওমতে সামলেছে আমাকে। আমাদের পরিবার ও প্রতিবেশীরাও মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন এই ঘটনায়।”
একসময় শান্তিপূর্ণ এলাকা হিসাবে পরিচিত হলেও সেখানে বিগত কয়েক বছরে এ জাতীয় ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে বলে জানিয়েছেন লাজবন্তী গেহলোত।
তিনি বলেন, “বিয়ের পর দশ বছর আমি এখানে শান্তিপূর্ণভাবে ছিলাম, তারপর প্রায় গত ২৫ বছর ধরে কোনও না কোনও সময়ে এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে। সব সময় পুলিশ এসে অল্পবয়সীদের ধরে নিয়ে গিয়ে মামলা করে দেয়। আমাদের উপর যেন তলোয়ার ঝুলছে।”
লাজবন্তীর ভাই জিতেন্দ্র শঙ্খলা থাকেন এখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। তিনি বলেন, “শুক্রবার রাতে আমাকে ফোনে জানানো হয় যে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা হয়েছে তাই আমার বোন আহত হয়েছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে এসে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।”
ওই এলাকার একের বাসিন্দা হরি দেওরা বলেন, “পাথর ছোঁড়ার ফলে অনেকের অনেক ক্ষতি হয়েছে। ঘটনার সময় আমি জালোরে ছিলাম। ঘটনার কথা জানতে পাড়ার পর থেকেই আমার পরিবারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রেখেছিলাম।”
“বাড়ি ফায়ার এসেই এফআইআর দায়ের করেছি। আমার বড় ভাই ছাদে গিয়েছিল কি হয়েছে দেখেতে। ছোঁড়া পাথরে তার মাথায় আঘাত লেগেছে। পাথরের আঘাতে বাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
‘এলাকাবাসীদের মধ্যে সম্প্রীতি রয়েছে’
হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এই উত্তেজনা দু’পক্ষের মানুষেরই ক্ষতি করেছে। তা সত্ত্বেও ওই এলাকাবাসীদের মধ্যে সম্প্রীতির কথা বলেছেন মহম্মদ রইস। জানিয়েছেন কীভাবে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে বাস করে এসেছে।
তার কথায়, “ওদের (হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ) ছাড়া আমরা চলতে পারব না আর ওরাও আমাদের ছাড়া চলতে পারবে না। আমাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ রয়েছে। আমাদের মধ্যে এত ভালো সম্পর্ক রয়েছে … জানি না কী কারণে এসব হয়েছে!”
তার কথায়, “দু’দিকেই কিছু সমাজবিরোধী রয়েছে, যারা এ জাতীয় ঘটনা ঘটায়। এই বাড়ি আমার বাপ-ঠাকুরদার আমলের। আমার বাবা হিন্দু ভাইদের জন্য জীবন উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত ছিলেন। আমরা সবাই এখানে মিলেমিশে থাকি।”
শিফা বিল্ডিংয়ের বাসিন্দা মুহাম্মদ রইস কেমন মানুষ, এই প্রশ্নের উত্তরে লাজবন্তী গেহলোতের ভাই জিতেন্দ্র শঙ্খলা বলেন, “আমার বোন লজবন্তীর বাড়ি রইসজির বাড়ির খুব কাছে। রইসজি খুব ভালো মানুষ।”
যারা পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের কথা বলছেন তাদের আমরা জিজ্ঞাসা করেছিলাম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার এই ঘটনার পেছনে কারা রয়েছে।
আসিফ খান বলেন, “বহিরাগতরাও এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত। আমাদের গুরুজনদের আমল থেকেই সবার মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। ভাল বোঝাপড়া রয়েছে কিন্তু বহিরাগতরা এসে এখানে দু’পক্ষের লোকজনকে উসকে দিয়ে চলে যায়।”
মুহাম্মদ রইস বলছেন, “সমাজবিরোধী কিন্তু দু’দিকেই থাকে। তারাই দু’দিকের মানুষকে উসকে দেয় আর এর ফলে এ জাতীয় ঘটনা ঘটে।”
যোধপুরে কেন বারবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হচ্ছে?
গত ২১শে জুন সুরসাগর এলাকায় ঘটে যাওয়া ঘটনা যোধপুরকে আরও একবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে শিরোনামে নিয়ে এসেছে। তবে এমন ঘটনা এখানে নতুন নয়।
২০২২ সালের ২রা মে একটা রাস্তার মোড়ে পতাকা উত্তোলন নিয়ে বিবাদ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার রূপ নিয়েছিল। সেই সময়েও প্রচণ্ড পাথর ছোঁড়া হয়, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে এবং দীর্ঘদিন পরিস্থিতি উত্তপ্ত ছিল।
যোধপুরের বিভিন্ন এলাকায় বহুবার হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা হয়েছে, যার ভয়াবহ স্মৃতি মানুষের মনে এখনও টাটকা।
তেমনই এক ঘটনার কথা জানিয়েছেন মুহাম্মদ রইস। তিন বলেন, “২০০৮ সালে একই ধরনের সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেছিল। সেই সময়ও আমাদের বাড়িকে টার্গেট করা হয়েছিল। ”
“সেইবার আমার মোটরসাইকেল পুড়েছিল আর এইবার এই দোকানটা পুড়েছে। ২০০৮ সালে পুলিশ আমাকে জোর করে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। ২০০৯ সালে আমায় সসম্মানে খালাস করা হয়।”
প্রবীণ সাংবাদিক নারায়ণ বরেঠ বলেন, “বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় যোধপুরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ায়। সেই সময় দুজনের মৃত্যুও হয়। এরপরেও রাজনৈতিক দলগুলো জনসচেতনতার জন্য কোনও কাজ করেনি।”
সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা না কমার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়ী করে তিনি বলেন, “নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনৈতিক চেতনা জাগানোর যে কাজ তাদের করা উচিত ছিল তা তারা করেনি।”
“আমাদের সমাজ ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের হাতে চলে গেছে। এই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তারই ফল।”
ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সমাজকর্মী কবিতা শ্রীবাস্তব বলছেন, “ঘৃণার রাজনীতি ক্রমাগত চলছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অসহিষ্ণুতাও।”
তিনি বলেন, “পুরো রাজনৈতিক পরিবেশটাই অসহিষ্ণুতায় মোড়া। আর আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই এই পরিবেশ মুসলিম বিরোধী। তাই সাধারণ হিন্দুদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা বাড়বে। তারপর আবার এর মধ্যে বজরং দল, আরএসএস-ও চলে আসে।”
সুরসাগরের ঘটনার কথা উল্লেখ করে কবিতা শ্রীবাস্তব বলেন, “গভীর রাতে সেখানে পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু পুলিশ আসতে দেরি করেছিল। পুলিশের গড়িমসির জন্যই উত্তেজনা বাড়তে থাকে।”
‘সুরসাগরের সাম্প্রতিক ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে তিন চতুর্থাংশেরও বেশি মানুষ মুসলিম সম্প্রদায়ের বলে অভিযোগ। এটাকেও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত।’ অভিমত রাখেন কবিতা শ্রীবাস্তব।
সূত্র : বিবিসি