বিক্ষোভের ডাক দিয়ে জিরো পয়েন্ট থেকে শূণ্য হাতে ফিরল আওয়ামী লীগ!

নিজস্ব প্রতিবেদক
11 November 2024 5:05 am
রাজধানীর জিরো পয়েন্ট এলাকায় নূর হোসেন চত্ত্বরে সকাল থেকেই বিভিন্ন সংগঠনকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ছাত্র-জনতা।

রাজধানীর জিরো পয়েন্ট এলাকায় নূর হোসেন চত্ত্বরে সকাল থেকেই বিভিন্ন সংগঠনকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ছাত্র-জনতা।

ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর প্রথম রাজনৈতিক কর্মসূচী দিয়ে মাঠে টিকতে পারেনি আওয়ামী লীগ। রাজধানী ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের গেটেই ছিল বিএনপি নেতাকর্মীরা। ছিল ছাত্ররাও। ফলে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার তিন মাস পর নূর হোসেন দিবসে জিরো পয়েন্টে বিক্ষোভ কর্মসূচি ডাক দিয়ে শূণ্য হাতে ফিরেছে আওয়ামী লীগ।

কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী সেখানে আসলেও তাদের মারধরের শিকার হতে হয় বিএনপি নেতাকর্মীদের হাতে। মারধরের শিকার এমন কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে আটক করে নিয়ে যেতেও দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।

রোববার সকাল থেকেই গুলিস্তান, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ও জিরো পয়েন্ট এলাকায় হকিস্টিক, ক্রিকেট খেলার স্টাম্প, লাঠিসোঁটা-সহ মিছিল শোডাউন ও মিছিল করতে দেখা যায় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের।

আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগ শনিবার তাদের ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে নূর হোসেন দিবসে কর্মসূচি পালনে দলীয় নেতাকর্মীদের অংশ নেওয়ার আহ্বান জানায়। এরপরই তা প্রতিহত করার ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-সহ আওয়ামী লীগ-বিরোধী বিভিন্ন সংগঠন।

শনিবার রাত থেকে জিরো পয়েন্টের নূর হোসেন চত্ত্বরে অবস্থান নেওয়ার পর রোববার জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে সংগঠনটি গণজমায়েত কর্মসূচি পালন করে। এই কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “আওয়ামী লীগ গণহত্যার সাথে যারা জড়িত, যতদিন তাদের বিচার নিশ্চিত না হবে ততদিন দলটির জনসম্মুখে আসার কোনো অধিকার নেই।”

নূর হোসেন দিবসে গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট চত্ত্বরে ফুল দিতে আসে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তাদেরও কেউ কেউ এসময় গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ এনে আওয়ামী লীগের বিচার ও রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের নিষিদ্ধের দাবিও জানায়।

বিএনপির দখলে ছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউ
দুপুর সাড়ে এগারোটার দিকে আমরা যখন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে যাই তখন সেখানে ছোট ছোট জটলা করে অবস্থান করছিল বিএনপি ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তাদের কারো কারো হাতে ছিল লাঠি, স্টাম্প। অনেকেই আবার মাথায় পতাকা বেঁধে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে স্লোগান দিচ্ছিলেন।

দুপুর দেড়টার দিকে শাহবাগ, রমনা থানাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে বিএনপির নেতাকর্মীরা একে একে মিছিল নিয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়। তাদের কারো কারো মাথায় যুবদল কিংবা বিএনপি লেখা ব্যান্ড বাঁধা থাকতেও দেখা গিয়েছে।

বিপ্লবী নামের বিএনপির এক নারী সংগঠক ক্রিকেট খেলার স্টাম্প হাতে নিয়ে শ্লোগান দিচ্ছিলেন আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের ঠিক গেটে। সাংবাদিকদের তিনি বলছিলেন, “এই স্টাম্প নিয়ে এসেছি, আওয়ামী লীগ তো বলছে আসবে। সাহস থাকে তো তারা আসুক। আমরা তাদের “আপ্যায়ন’ করব।”

বেলা দুইটার দিকে রাস্তার ওপর অবস্থান নিয়ে শ্লোগান দিতে শুরু করে বিএনপি নেতাকর্মীরা। রমনা থানার এক বিএনপি কর্মী এসময় বলেন, “জুলাইয়ে আওয়ামী লীগের হাতে কত মানুষ মারা গেলো, হাজার হাজার মানুষ চোখ হারাল, পঙ্গু হলো। অথচ দলটির কোন অনুশোচনা নেই। এখন তারা আবার ছাত্রদের রক্তের ওপর কীভাবে রাজনীতিতে ফিরতে চায়?”

বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়টি পুড়িয়ে দেয়া হয় গত পাঁচই অগাস্ট। সেটি কার্যত এখন একটি পোড়া ধংসস্তুপ।

কর্মসূচিতে অংশ নিতে এসে বিএনপি নেতাকর্মীদের অনেককেই সেখানে এসে সেলফি তুলতেও দেখা যায়।

আওয়ামী লীগ সন্দেহে মারধর
গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে যখন বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা এই কর্মসূচি পালন করছিল তখন কিছুক্ষণ পরপরই হৈচৈ ও জটলা দেখা যায়।

দুপুর আড়াইটা। হঠাৎই পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি সেখানে আসলে বিএনপি নেতাকর্মীরা তাকে মারধর করতে শুরু করে। তখন তিনি নিজেকে বিএনপি সমর্থক বলে দাবি করেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত বিএনপির কয়েকজন তাকে আওয়ামী লীগের কর্মী বলে মারধর শুরু করে।

ওই ব্যক্তির মোবাইল ফোনটিও চেক করা হয়। পরে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় পুলিশ সদস্যরা। ঠিক তার কয়েক মিনিটের মাথায় সেখানে যুব মহিলা লীগের এক কর্মীকে ধাওয়া দেয় বিএনপির কয়েকজন নারী কর্মী। সেখানে বিপ্লবী নামে ওই বিএনপি কর্মীও ছিলেন।

নিজেকে বাঁচাতে যুব মহিলা লীগের ওই কর্মী বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের দোকানে আশ্রয় নিতে চেষ্টা করলে তাকে ধরে এনে পুলিশে দেওয়া হয়।

একই সময় ঠিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিক সামনে থেকে আরেক নারী কর্মীকে মারধর করে পুলিশে দেয় বিএনপি নেতাকর্মীরা।

এর আগে সকালে ওই এলাকায় জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগের কয়েকজন মারধরের শিকার হয়েছেন বলে স্থানীয় কয়েকজন দোকানদার জানিয়েছে।

বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের গেটে দুইজনকে মারধর করা হয়। তাদের একজন গলায় প্রেস লেখা কার্ডও ঝুলিয়ে রেখেছিলেন।

তার কাছে পরিচয় জিজ্ঞেস করা হলেও কিছু জানাননি তিনি। তবে এদিন আওয়ামী লীগের আরো দুয়েকজন নেতাকে ‘প্রেস’ লেখা কার্ড ও মুখে মাস্ক দিয়ে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ এলাকায় অবস্থান করতে দেখা গেছে। কিন্তু তারা কোনও ধরনের মিছিল বা স্লোগানে অংশ নেয়নি।

শনিবার রাতে ভাবী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি-সহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আটক করা হয়েছিল।

তবে রোববার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে যাদের আওয়ামী লীগ সন্দেহে মারধর ও আটক করা হয়েছে তাদের কারো হাতে এধরনের কোন ছবি বা প্ল্যাকার্ড দেখা যায়নি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের অবস্থান
শনিবার আওয়ামী লীগ নূর হোসেন দিবসে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণার পর ওইদিন রাতেই তা প্রতিহত করতে গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট এলাকায় গণজমায়েতের ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

এর আগে শনিবার রাত থেকেই তারা ওই এলাকায় অবস্থান নেয়। রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ‘ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ মঞ্চ’-র ব্যানারে অনুষ্ঠান শুরু করে সংগঠনটি।

সেখান থেকে সংগঠনটির নেতারা আওয়ামী লীগের বিচার ও তাদের রাজনীতি বন্ধে সরকারের কাছে দাবিও জানায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও সমন্বয়ক সারজিস আলম এসময় বলেন, “রাজনৈতিক বিভাজন ভুলে আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে”।

তিনি বলেন, এখন কেউ কেউ বিগত ১৬ বছরের দু:শাসনকে ভুলে গত ৩ মাসের পেছনে লেগেছে। গণমাধ্যমকে এ ব্যাপারে সজাগ থাকারও আহবান জানান তিনি।

এই গণজমায়েত কর্মসূচিতে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ছাড়াও গণঅভ্যুত্থানে আহত ও নিহতদের পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।

সন্ধ্যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “আওয়ামী লীগ ফিরবে, অবশ্যই ফিরবে, তবে, সেটি হচ্ছে বিচারের জন্য, ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলার জন্য। গণহত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজনীতি করতে পারবে না।”

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা
এই কর্মসূচি ঘিরে ওই এলাকায় বেশ তৎপর ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। সকালে গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টের দিকে যেতেই সচিবালয়ের সামনে চোখে পড়ে সেনাবাহিনীর দুটি এপিসি গাড়ি ও তল্লাশি চৌকি।

সামনে এগিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা যায় সেনাবাহিনী ও পুলিশের কড়া পাহারা। কিছুক্ষণ পরপর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবির টহল টিমের টহলও লক্ষ্য করা যায়।

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ও গুলিস্তানের বিভিন্ন পয়েন্টে সেনাবাহিনীর সদস্যদের একেকটি দলকে টহল দিতে দেখা যায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই এলাকায় আওয়ামী লীগ সন্দেহে যারাই মারধরের শিকার হয়েছেন তাদেরকে উদ্ধার করতে বেশ তৎপর ছিল পুলিশ।

এর মধ্যেই সকাল থেকে জিরো পয়েন্টে নূর হোসেন চত্ত্বরে ফুল দিতে আসে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সেখানে ফুল দিয়ে তাদের অনেককেই আওয়ামী লীগ বিরোধী শ্লোগান দিতেও দেখা যায়। এই এলাকা ঘিরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ছাত্র শিবির, গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন।