৫০ বছরে দেশ থেকে পাচার ১২ লাখ কোটি টাকা!

6 June 2024 9:22 pm

প্রতিবছর আশংকাজনক হারে বাড়ছে অর্থপাচার। ছবি : সংগৃহীত

এক দেড় হাজার কোটি নয়, দেশ থেকে গত পাঁচ দশকে পাচার হয়েছে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা। স্বাধীনতার পরের অর্থবছর থেকে এই লুটপাট শুরু হয় যা এখনো চলমান। এই চাঞ্চল্যকর পাচার কাহনের এক হিসাব তুলে ধরেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারাকাত গত বছর এক সরকারের বিকল্প বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপনকালে এই দাবি করেছিলেন। বস্তুত, পাচার কার্যক্রম আরো ভয়াবহ বলে গবেষকমহল মনে করেন।

সমিতির হিসাবে ১৯৭২-৭৩ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত পাচার হওয়া অর্থের ৫ শতাংশ উদ্ধার করা গেলেও সরকার ৫৯ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা পাবে। দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ উদ্ধারের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান উৎস হতে পারে এই কালো টাকা।

বারাকাত বলেন, ১৯৭২-৭৩ থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত ৫০ বছরে দেশে কালো টাকার পরিমাণ ১৩২ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। এর মাত্র ২ শতাংশও উদ্ধার করা সম্ভব হলে সরকার ২ লাখ ৬৫ হাজার ৭০ কোটি টাকা পেতে পারতো।

বারাকাত আরো বলেন, দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সম্পদ, আয় ও আবাসনে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এখন পুষ্টিতেও চলে গেছে। যারফলে বাজেটের কাঠামো বৈষম্য দূর করার নীতির ভিত্তিতে করা উচিৎ। আমাদের অর্থনীতির প্রধান সমস্যা হচ্ছে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য। আমরা আগামী বাজেটকে মাপবো, বাজেটে এই ক্রমবর্ধমান বৈষম্য দূর করতে কী করা হচ্ছে। কারণ এ বৈষম্য দূর করার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে বাজেট।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘‘আমরা এই বাজেটের বিভিন্ন বিষয় সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন নিয়ে আগেই সরকারের সঙ্গে কথা বলেছি। এখন বিস্তারিত বাজেট তৈরি করে ফের সরকারের কাছে প্রতিবেদন আকারে জমা দিব। প্রস্তাবিত বাজেট আলোচনায় সংশোধন করা যায়। সরকারের হাতে সেই সময় আছে।’’

বাজেটে কয়েকটি খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে জানিয়ে বারকাত বলেন, মানুষ বহুমাত্রিক কারণে দরিদ্র হয়ে পড়ছে। কোভিডের কারণে মানুষের আয় কমে গিয়েছে। মধ্যবিত্ত মানুষও নিম্নবিত্তের দিকে যাচ্ছে।

আগামী ১০ বছরে ছয়টি লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিকল্পনা তুলে ধরে বিকল্প বাজেট প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে বলে জানান সমিতির সভাপতি অধ্যাপক বারকাত।

মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিলুপ্তপ্রায় জানিয়ে এসব লক্ষ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ৭০-৮০ শতাংশ মানুষকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উন্নীত করা, বৈষম্য সর্বনিম্ন শ্রেণিতে নামিয়ে আনা, ধনিক শ্রেণির সম্পদ দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে বণ্টন, উন্নয়নে দেশজ অর্থনীতিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া, মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক ও আলোকিত করার সুযোগ সৃষ্টি এবং মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, লাগামহীন কর্মবাজার সংকোচন, মহামারী ও ইউক্রেইন-রাশিয়ার যুদ্ধের অভিঘাতের বিষয় মাথায় রেখে বিকল্প বাজেট তৈরি করা হয়েছে।

বিকল্প বাজেটের রাজস্ব আদায়ের হিসাব তুলে ধরে সমিতির সভাপতি বলেন, এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের মধ্যে আয়, মুনাফা ও মূলধনের ওপর কর অর্থাৎ আয়কর থেকে আসবে ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।

দেশে কোটি টাকার বেশি আয়কর দেন ১০০ জনের মতো জানিয়ে তিনি বলেন “আমাদের গবেষণা বলছে, ৪ লাখ ১৮ হাজার মানুষ কোটি টাকার ওপরে কর দেওয়ার কথা। আর সম্পদ কর নেওয়া হয় না। এই খাতে ২ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা আসা সম্ভব।”

দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ‘বহুমাত্রিক দরিদ্র’ মন্তব্য করে অর্থনীতিবিদ বারকাত বলেন, ধনী ও অতি ধনীর সংখ্যা ১ শতাংশ। বহুমাত্রিক দরিদ্রের সংখ্যা কোভিডকালীন সময়ের চেয়ে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, অপরদিকে প্রকৃত মজুরি না বাড়ায় জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে। সঞ্চয় ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে।

বৈষম্য কমাতে সম্পদ করে হাত দেওয়ার পরামর্শ জানিয়ে তিনি বলেন, সম্পদশালীদের ওপর কর কমানো হলে বৈষম্য কমে না। এছাড়া সমাজের ৯০ শতাংশ কম আয়ের মানুষের ওপর কর কামালে তাদের কর্মসংস্থান ও আয় বাড়ে।

সংবাদ সম্মেলনে ভোটে বাধা দিলে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা বিষয়ক এক প্রশ্নে তিনি বলেন, দেশে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের সংখ্যা ৯০ শতাংশ; যাদের আমেরিকার ভিসা দরকার নেই। ভিসা না দিলেও এদের কোনো সমস্যা নেই।

“বরং এই শ্রেণির মানুষদের ভিসা পেলে সমস্যা। তাহলে যাওয়ার জন্য টাকা-পয়সা খুঁজবে। এটা নিয়ে রাজনৈতিক দলের লোকজন চিন্তা করবে।”

অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. আইনুল ইসলামের সঞ্চালনায় বিকল্প বাজেট উপস্থাপনকালে অনলাইনেও বিভিন্ন স্থান থেকে যুক্ত ছিলেন অনেকে।