চাকরিতে কোটাকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনায় মামলা ও গ্রেপ্তার ধরপাকড় চলছেই। নিহতদের বিষয়েও সরকারি তরফে দেওয়া হচ্ছে নানা রকম বিবৃতি। নিহতের সংখ্যা নিয়েও চলছে ধোয়াশা। সরকারি হিসাবেই সহিংসতায় এ পর্যন্ত দুইশ মানুষ নিহত হন। আহত শত শত মানুষ এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এরমধ্যে আজকেও মারা গেছেন একজন। তার নাম ইয়ামিন চৌধুরীর (১৯)। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে গুলিবিদ্ধ আরও এক যুবকের চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে। তিনি পোশাককর্মী। বাড়ি কিশোরগঞ্জ। গত ১৯ জুলাই বাড্ডা এলাকায় তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। আজ শনিবার সকাল ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) তিনি মারা যান।
কোটাবিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে গড়ে উঠা ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর তিন সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, নাহিদ ইসলাম ও আবু বাকের মজুমদারকে আজ বিকেলে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ওই অভিযোগ ওঠার পর রাতে গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, “নিরাপত্তাজনিত কারণে” তাদের হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান হারুন-অর রশীদ গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন, ওই ছাত্রনেতারা তাদের হেফাজতে রয়েছেন। অথচ এর আগে গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে হারুন বলেছিলেন, এ ব্যাপারে তারা কিছু জানেন না।
আবু সাঈদের মৃত্যুর মামলায় ভিন্ন বয়ান?
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে জোরালো অভিযোগ উঠলেও পুলিশ দায়ের করা মামলায় ভিন্ন বয়ান দেওয়া হয়েছে। সেখানকার প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যাওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে পুলিশের গুলি আবু সাঈদের দেহে লাগছে। এ বিষয়ে নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীও বলেছেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কোনো ধরনের গুলির নির্দেশনা দেওয়া ছিল না। কিন্তু রংপুরের ছাত্রটি (আবু সাঈদ) কীভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হলো, সেটি তদন্তের বিষয়। আমরা সেটার সঠিক তদন্তের দাবি জানাই। একইসাথে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের শিক্ষার্থীকে কে বা কারা গুলি করেছে, আমরা তারও সুষ্ঠু বিচার দাবি করি। কারণ, ওই শিক্ষার্থী যেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছে, সেখানে তার যাওয়ার কথা নয়।’
মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণী বা এফআইর-এ পুলিশ দাবি করেছে, আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়নি বরং মামলায় পুলিশ এমন একটি বর্ণনা দিয়েছে যাতে আবু সাঈদ নিহতের ঘটনায় বিক্ষোভকারীদের ওপর দায় চাপানো হয়েছে।
যদিও ১৬ই জুলাই আবু সাঈদ গুলিতে নিহত হবার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। পরে ১৮ ও ১৯শে জুলাই ঢাকাসহ সারাদেশে সহিংসতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, যার জের ধরে ১৯শে জুলাই রাতে কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েন করে কর্তৃপক্ষ।
আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি দু হাত প্রসারিত করে সড়কে দাঁড়িয়ে আছেন। আর উল্টো দিক থেকে পুলিশ শটগান থেকে বারবার গুলি ছুঁড়ছে। এক পর্যায়ে গুলিবিদ্ধ সাঈদকে অন্য শিক্ষার্থীরা হাসপাতালে নিয়ে যায়, এবং ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে।
যদিও এফআইআরে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন যে, ‘বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন দিক থেকে গুলি ছুঁড়তে থাকে এবং ইটের টুকরো নিক্ষেপ করতে থাকে। এক পর্যায়ে এক শিক্ষার্থীকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখা যায়।’ ওই এফআইআরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী সহ অজ্ঞাত কয়েক হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগ করা হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা এ নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে রাজী হননি। তবে এফআইএর দায়েরের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে, তিনি ‘মামলা করেছেন কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তা তার তথ্য যাচাই করে দেখবেন’।
গ্রেপ্তার সাড়ে ৫ হাজারের বেশি
কোটা নিয়ে সহিংসতার ঘটনায় এ পর্যন্ত ঢাকায় বিভিন্ন থানায় ২০৯টি মামলায় ২ হাজার ৩৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপি। সহিংসতা, ভাঙচুর এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য স্থানে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দায়ের করা হয় এসব মামলা। মামলা হয়েছে সারাদেশেও। সারাদেশ থেকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে কয়েক হাজার মানুষকে।
দেশজুড়ে সহিংসতার ঘটনায় শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৩৬ ঘণ্টায় রাজধানীসহ আরও কয়েকটি জেলায় কমপক্ষে ৭৩৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ নিয়ে গত সাত দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীসহ ৫ হাজার ৫২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হলো।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত ঢাকায় বিভিন্ন থানায় সহিংসতা, ভাঙচুর এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য স্থানে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২০৯টি। এসব মামলায় ২ হাজার ৩৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপি। গতকাল শুক্রবারও ১৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আদালতের নথি অনুযায়ী, গতকাল ৬৭টি মামলায় বিএনপি ও জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতাসহ ২১১ জনকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয়।
গত ১৮ জুলাই সেতু ভবনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় সাবেক ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরকে পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে গতকাল ঢাকার একটি আদালত কারাগারে পাঠান। গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গণঅধিকার পরিষদ জানায়, সংগঠনটির সভাপতি নূরকে রিমান্ডে নির্যাতন করা হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘নূরকে যখন আদালতে হাজির করা হয়, তখন তিনি ঠিকমতো হাঁটতে পারছিলেন না। তিনি তার স্ত্রী ও আইনজীবীকে বলেছিলেন যে, রিমান্ডে তাকে নির্যাতন ও মারধর করা হয়েছিল।’
রামপুরায় বিটিভি ভবন ভাঙচুরের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় বিএনপির প্রচার বিষয়ক সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুসহ বিএনপি ও জামায়াতের ছয় নেতাকে পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।
অন্য পাঁচ আসামি হলেন- বিএনপি নেতা কাজী সায়েদুল আলম বাবুল, আমিনুল হক, এম এ সালাম, মাহমুদুস সালেহীন ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার।
গতকাল এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা শাখা) হারুন অর রশিদ জানান, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও শনির আখরায় দুই পুলিশ সদস্যকে হত্যার ঘটনায় ডেমরা থানা শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মাসুদ রানাসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে তারা।
অন্য পাঁচজন হলেন- ইরফান, আবু বকর, রবিউল ইসলাম, সৌরভ মিয়া ও তারেক। ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তাদের আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।