কোনো কোনো জয়ও পরাজয়ের সমান। যেমনটা ভারতের এবারের লোকসভা নির্বাচনে জিতেও পরাজিত নরেন্দ্র মোদী। ভারতের প্রতাপশালী জনতা পার্টির প্রধানমন্ত্রী। ভোটের শুরুতে এমন কোনো কারিকুরি নেই যে করেননি। বিরোধী কংগ্রেসের নেতাকর্মীদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছেন, কোনঠাঁসা করেছেন, প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছেন এমনকি অনেককে জেলেও পুরেছেন। নিজেকে ঘোষণা দিয়েছেন ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষ হিসেবে! বলেছেন, তিনি এবং তার দল এবার রেকর্ড ৪০০ আসন পাবে! কিন্তু ভোটে নিরব বিপ্লব দেখিয়ে দিয়েছে ভারতবাসী। তার যাবতীয় কারিকুরি কাজে আসেনি। প্রত্যাশার চেয়ে বেশি হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হওয়া লোকসভা নির্বাচনে তাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টানা তৃতীয় দফায় জয়ী হলেও তাঁর হিন্দুত্ববাদী সুর বড় বেসুরো হয়ে গেছে। তার দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) যতসংখ্যক আসন (২৪০) পেয়েছে, সেটি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকেও কম।
ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভার ৫৪৩ আসনের মধ্যে নিরঙ্কুশ তথা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার জন্য বিজেপির প্রয়োজন ছিল ২৭২টি আসন। তবে দলটির এনডিএ জোটের শরিকেরা বাড়তি আসন পেয়েছে। বরং কংগ্রেস এবার ধংসস্তুপ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অর্ধশত থেকে তারা এবার ৯৯টি আসন পেয়েছে।
নির্বাচনের এ ফলাফল নরেন্দ্র মোদির জন্য এক ব্যক্তিগত আঘাত। কেননা, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এর আগে তিনি যেসব নির্বাচন করেছেন, সেগুলোয় সব সময়ই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন। সেই সঙ্গে এক দশক ধরে ব্যাপক প্রভাব ফেলে চলেছেন দেশটির রাজনীতিতে।
আসনসংখ্যার দিক থেকে মোদির বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতি হলো ৬০টি কম পাওয়ার বিষয়। এটি তৃতীয় দফায় তাঁর দলের এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রত্যাশাকে ম্লান করে দিয়েছে। নির্বাচনী ফলাফলে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ‘ইন্ডিয়া’ জোটের বিস্ময়কর উত্থান লক্ষ করা গেছে। তাতে জোটের আসন কমে যাওয়া নিয়ে অনুমান এবং বুথফেরত ও নির্বাচনপূর্ব জরিপগুলোর ফলাফল অনেকটাই ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
ছয় সপ্তাহ ধরে চলা সাত দফার এ ম্যারাথন নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন ৬৪ কোটির বেশি ভোটার। এটি এক ‘বিশ্ব রেকর্ড’। এ ভোটারদের প্রায় অর্ধেক ছিলেন নারী।
বিশ্বের অনেক নেতাই তাঁদের তৃতীয় দফা নির্বাচনের শেষ লাইন পেরিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদিও এর ব্যতিক্রম নন। আসনসংখ্যা বিবেচনায় এখনো ভারতের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল হয়ে রয়েছে বিজেপি। জোট শরিকদের সমর্থন নিয়ে মোদি যদি তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসেন, তবে দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর রেকর্ডের ভাগীদার হবেন তিনি।
অন্যদিকে এ ফলাফল কংগ্রেস শিবিরে এনে দিয়েছে আনন্দ উদ্যাপনের উপলক্ষ। পাশাপাশি তা হতাশ করেছে বিজেপি শিবিরকে। একক বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হলেও প্রচার ও প্রত্যাশার চাপ পূরণ করতে না পেরে এ ফলাফল বিজেপির অনেক সমর্থকের হৃদয় ভেঙেছে।
নির্বাচনের আগে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের ঘাঁটিগুলোয় প্রতিশ্রুতির নানা ফুলঝুরি ছড়িয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতশাসিত কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাহার, অযোধ্যায় গুঁড়িয়ে দেওয়া ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের স্থানে রামমন্দির নির্মাণ ও বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন কার্যকর করা। এ ছাড়া বিজেপি-নিয়ন্ত্রিত অনেক রাজ্য আন্তধর্মীয় বিয়ের ওপর কঠোর আইন প্রয়োগ করেছে।
মোদির উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রচার ‘আব কি বার, ৪০০ পার’ (এবার ৪০০ পার)–এর লক্ষ্য ছিল, তাঁর এনডিএ জোটের ৪০০ আসন দখল। এই প্রচারও মোদির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হয়ে থাকতে পারে। কেননা, এমন প্রচার ভারতের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ আশঙ্কা বাড়িয়ে দিতে পারে যে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে তাঁদের নিয়ে সংবিধানে নেতিবাচক পরিবর্তন আনা হতে পারে।
মোদির দল সবচেয়ে বেশি বাধার মুখে পড়েছে ভারতের সর্ববৃহৎ রাজ্য উত্তর প্রদেশে। রাজ্যের ৮০টি আসনের মধ্যে ৩৩টি পেয়েছে বিজেপি। দেশটির জাতীয় রাজনীতিতে এ রাজ্যের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। অনেকেরই ধারণা, ‘এ রাজ্য যার, দিল্লি তার’। উত্তর প্রদেশ রাজ্যে বিজেপির মোদি ও কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী উভয়ের আসন রয়েছে।
ম্লান ‘মোদি ব্র্যান্ড’
মোদির জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল ‘মোদি ব্র্যান্ডে’। বিশেষ এই প্রচারণার অধীন নিয়মিত কাজকেও তুলে ধরা হয়েছিল ফলাও করে। দুর্বল বিরোধী দল ও বন্ধুসুলভ গণমাধ্যম এ ব্র্যান্ডকে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করেছিল।
কিন্তু নির্বাচনী ফলাফলে দেখা গেল, মোদি ব্র্যান্ড একরকম জৌলুশ হারিয়েছে। এক কথায়, মোদিকে নিয়ে তাঁর অনেক সমর্থক যেমনটা ধারণা করতেন, প্রকৃতপক্ষে অতটা অজেয় নন তিনি। মোদি ব্র্যান্ড ম্লান হওয়াটা বিরোধীদের নতুন আশার সঞ্চার করেছে।
এবার বিজেপি যদি সরকার গঠন করতে চায়, তবে মিত্রদের ওপর নির্ভর করতে হবে তাকে। সে ক্ষেত্রে দলটিকে নিতে হবে অধিকতর পরামর্শমূলক ও বিচার-বিবেচনাপ্রসূত দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয়।
শরিকেরা নিজেদের অবহেলিত মনে করলে জোট রাজনীতির নির্ভরশীলতা সরকারকে ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে ফেলবে। যে দল একসময় নিজেদের সর্বেসর্বা বলে মনে করত, ক্ষমতায় যেতে সেই বিজেপি এখন মিত্রদের দিকে তাকিয়ে; যেটি ছিল না ২০১৪ ও ২০১৯ সালে। ঈশ্বরের প্রেরিত নেতাকে এবার নির্ভরশীল নেতা বানিয়ে দিয়েছে ভারতবাসী। এই জয় তাই পরাজয়েরই সমান বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এপি, এএফপি ও রয়টার্স