আন্দোলন ঠেকাতে মরিয়া ছাত্রলীগ, ক্যাম্পাস রণক্ষেত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক
15 July 2024 7:17 pm
হামলাকারীদের হাতে রড, লাঠি, হকিস্টিকসহ দেশীয় নানা অস্ত্র দেখা যায়। ছবি : সংগৃহীত

হামলাকারীদের হাতে রড, লাঠি, হকিস্টিকসহ দেশীয় নানা অস্ত্র দেখা যায়। ছবি : সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের প্রায় প্রতিটি ক্যাম্পাসে এখন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ এবং কোটাবিরোধী আন্দোলনে নামা শিক্ষার্থীরা। কয়েকদিন ধরে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা চললেও আজ সোমবার সংঘর্ষে রূপ নেয়। ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে হামলা করেছে ছাত্রলীগ। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচী ঘিরে সোমবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে সংঘাত। এতে সাংবাদিকসহ শতাধিক আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

এ সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে রড লাঠি হকিস্টিকসহ দেখা যায়। সংঘর্ষের খবর মিলেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য ক্যাম্পাস থেকেও।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সংঘর্ষের সময় দৈনিক জনকণ্ঠের একজন ফটো সাংবাদিকও আহত হন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, রিকশা, অটোরিকশায় করে কাটা-ছেঁড়াসহ বিভিন্ন ধরনের আঘাত নিয়ে শতাধিক আহতকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। ওই সময় আহতরা কেউ চিৎকার করছিলেন, কান্নাকাটি করছিলেন। তাদেরকে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

ভিডিও ফুটেজ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে, হামলার সময় একদল হেলমেট পরিহিত তরুণরাও ছিলেন। এসময় তাদেরকে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় দেখা গেছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অনেকে এ সময় আশপাশের ভবনে অবস্থান নেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আহত বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আহত অবস্থায় মেডিকেলের দিকে নিয়ে যেতে দেখা গেছে।

উত্তেজনা চলাকালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আলী ওয়াসিফ ইনান গণমাধ্যমে বলেন, রাজাকার স্লোগান দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কলঙ্কিত করা হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে ছাত্রলীগ তাদের প্রতিহত করেছে।

এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বহিরাগতদের কর্তৃক হলে হামলা ও ভাঙচুররের অভিযোগ করেন। আন্দোলনকারীরা সরে পড়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রড, লাঠি নিয়ে মিছিল করতে দেখা গেছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের।

এর আগে সোমবার দুপুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলছেন, আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া বক্তব্য অপমানজনক। এই বক্তব্য আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ করেছে।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “গত রাতে বিক্ষোভ করে আমরা সোমবার ১২টার প্রধানমন্ত্রীকে তার বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিলাম। প্রত্যাহার না হওয়ায় আমরা রাস্তায় নেমেছি”।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলছেন, কোটা সংস্কারে সরকারকে দেয়া দাবি না মানা পর্যন্ত তাদের এই আন্দোলন অব্যহত থাকবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে বিবিসি সংবাদদাতা জানান, দুপুর ১২টা থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হতে থাকে।

এই আন্দোলনকে ঘিরে শাহবাগসহ আশপাশের রাস্তায় জলকামানসহ বিপুলসংখ্যক পুলিশ অবস্থান নিয়েছে।

উত্তেজনার শুরু যেভাবে

রাজু ভাস্কর্যে কোটা আন্দোলনকারীদের পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচীর বিপরীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অপমান’ করার প্রতিবাদে পাল্টা কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল ছাত্রলীগ।

কোটা আন্দোলনকারীরা কর্মসূচী শেষে মল চত্বর এলাকার দিকে গেলে বিপরীত দিক থেকে ঢিল ছুড়তে ছুড়তে তাদের ওপর চড়াও হয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিসি সংবাদদাতা জানিয়েছেন, বিকেল চারটার দিকে আন্দোলনকারীদের ভিসি চত্বর এলাকায় থেকে সরে যেতে দেখা গেছে। এসময় বেশ কয়েকজনকে রিকশায় করে নেয়া হয় হাসপাতালে।

সংঘর্ষের আগে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, শিক্ষার্থীরা শুরু থেকে অহিংস আন্দোলন করে আসছে। এখন শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সহিংসভাবে দমানোর চেষ্টা হলে উদ্ভুত পরিস্থিতির দায় সরকারকে নিতে হবে।

আন্দোলন চলবেই…

দুপুর ১২টার আগ থেকেই এই বিক্ষোভে অংশ নিতে আসতে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা কলেজ, বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, ঢাকা নার্সিং কলেজসহ আশপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।

পূর্ব ঘোষণা অনুয়ায়ী সোমবার দুপুর ১২টা থেকে ঢাবির বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্য এলাকায় জড়ো হতে থাকেন। এ সময় আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন স্লোগান দেন। রাজু ভাস্কর্যের সামনে এদিন শিক্ষার্থীরা ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’সহ নানা ধরনের স্লোগান দেন।

রাজু ভাস্কর্যের সামনে ওই আন্দোলনে অংশ নেওয়া এক শিক্ষার্থী বলেন, প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মনে আঘাত দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বাইরে সবাইকে রাজাকার বলেছেন। আমরা তার বক্তব্য প্রত্যাহার ও যৌক্তিকভাবে কোটা সংস্কারের দাবি জানাই। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবেই।

ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীদের বাধা

কোটা সংস্কারের এক দফা দাবিতে আন্দোলনরত ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে বিক্ষোভে যাওয়ার সময় ইডেন মহিলা কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছে ও বাধা দিয়েছে।

তারা বলছেন, ইডেন কলেজে ছাত্রলীগ আন্দোলনকারী ছাত্রীদের ওপর হামলা করেছে। এই হামলায় কয়েক ছাত্রী আহত হয়েছেন বলেও জানান তারা।

বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ইডেন কলেজে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে।

গতকাল রবিবার মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। একই সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করলে সেখানে ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠে।

মিছিল হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও। রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন থেকে আসা বক্তব্যের পর রবিবার রাত সাড়ে দশটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর ভেতরে মিছিল শুরু হয়, যা পরে বিক্ষোভে রূপ নেয়। এক পর্যায়ে বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে এসে টিএসসি এলাকায় জড়ো হতে থাকে।

ছাত্রী হলগুলো থেকেও ছাত্রীরা বেরিয়ে এসে মিছিল সমাবেশে অংশ নেয়। মিছিল টিএসসি থেকে শাহবাগ এলাকা প্রদক্ষিণ করে। মিছিলকারীদের অনেকে হল থেকে নিয়ে থালা বাসন হাতে নিয়ে স্লোগানের তালে তালে গলা মেলান।

পাশাপাশি হলগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও হলগুলোর গেইটে অবস্থান নেয়।

সোমবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলছিল। সেখানে শিক্ষার্থীদের মিছিলে ছাত্রলীগের হামলা হয়। এদিন বেলা সাড়ে তিনটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের সামনে হামলার ঘটনাটি ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই আন্দোলনরত এক শিক্ষার্থীর মাথা ফেটে যায়। পাশাপাশি বেলা আড়াইটার শাটল ট্রেন ক্যাম্পাস থেকে ছাড়তে দেয়নি ছাত্রলীগ। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই ক্যাম্পাস থেকে ট্রেনে চড়ে চট্টগ্রাম শহরে গিয়ে বিক্ষোভে অংশ নেন। ট্রেন বন্ধ থাকায় তাঁরা শহরে যেতে পারেননি।