যাত্রীরা টিকিট পাচ্ছে না। ফ্লাইটের টিকিট না থাকলে বিমানে আসন ফাঁকা থাকবার কথা নয়। কিন্তু এই অদ্ভূত সমস্যাই চলছে রাষ্ট্রীয় এই এয়ারলাইন্স কোম্পানিতে। সমস্যা সমাধানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নতুন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আশ্বাসও দিয়েছেন। তবে এর সাথে বিমানের ‘ভেতরের ও বাইরের যে চক্র’ জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারলে সংকটের সমাধান হবে কি না, সন্দেহ রয়েছে বিশ্লেষকদের।
ট্রাভেল এজেন্টদের একজন শীর্ষ নেতা বলেছেন, টিকেট নিয়ে এ সংকটের জন্য বিমানের ব্যর্থতাই দায়ী এবং ‘সর্ষের মধ্যকার ভূত তাড়াতে’ না পারলে এ সমস্যার সমাধান হবে না।
খোদ বিমানের তথ্যমতে, গত অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি একুশটি উড়োজাহাজ (এয়ারক্রাফট) দিয়ে ৩২ লাখ যাত্রী পরিবহন করেছে। কিন্তু গত মার্চে ঢাকা-লন্ডন রুটের একটি ফ্লাইটের আসন ফাঁকা থাকার একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। তখনই ‘টিকেট নেই তবুও আসন ফাঁকা’ থাকার বিষয়টি আবারো সামনে উঠে আসে।
তবে গত ১৫ মার্চ বিমান এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিলো যে ‘আসন খালি থাকা সত্ত্বেও টিকিট কিনতে গেলে বলে টিকিট নেই’- এটি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ঢালাও মনগড়া একটি অভিযোগ।
এতে বলা হয়েছিলো, “বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সব টিকিট সবার কাছে বিক্রির জন্য উন্মুক্ত। যেকোনো অনুমোদিত ট্রাভেল এজেন্ট ছাড়াও বিমানের নিজস্ব ওয়েবসাইট, মোবাইল অ্যাপ এবং বিমানের নিজস্ব বিক্রয় কেন্দ্র থেকে বিমানের টিকিট কেনা যাবে”।
এমন পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের এক সাথে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় বিমানের নতুন এমডি জাহিদুল ইসলাম ভূঞা বলেছেন যে ‘টিকেট নিয়ে সমস্যা তারা পুরোপুরি সমাধান করতে চান’ যাতে করে এ নিয়ে আর প্রশ্ন না ওঠে।
কিন্তু ‘টিকেট নেই কিন্তু আসন ফাঁকা’ সমস্যার কারণ আসলে কী? সংশ্লিষ্টরা কী বলতে চান? বিমানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এম এ মোমেন বলেছেন, বিমানের টিকেট না পেয়ে এজেন্সি থেকে বেশি দামে কেনার অভিজ্ঞতা তার নিজেরই আছে। তিনি বলেন, আমি তখন ভিন্ন একটি সংস্থায় ছিলাম। টিকেট কিনতে গিয়ে দেখি নেই। পরে এজেন্সির কাছ থেকে কিনে ফ্লাইটে উঠে দেখি অন্তত পনেরটি আসন ফাঁকা পড়ে আছে।
আসন ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও টিকেট না থাকার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিমানের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছে যে পুরো বিষয়টি বিমানের এক শ্রেণির কর্মকর্তা ও কিছু এজেন্সির কারসাজি।
‘ধরুন ১৫০ টি আসন আছে। আপনি তিনটি এজেন্সিকে ১০০টি দিয়ে রাখলেন। তারা নাম মাত্র মূল্যে বুকিং দিয়ে রেখে দিলো। শেষ পর্যন্ত চড়া দামে কিছু বিক্রি করলো। বাকীগুলো শেষ মুহূর্তে বিমানকে ফেরত দিয়ে দিলো। এ অবিক্রীতগুলো পরে আর বিক্রি করা যায় না। আবার ডিজিটাল পদ্ধতিতে এখন বিমান টিকেট বিক্রি করলেও এই সিস্টেমটাও ম্যানিপুলেশনের সুযোগ আছে।’
বিমানের সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, ধরুন ১৫০ টি আসন আছে। আপনি তিনটি এজেন্সিকে ১০০টি দিয়ে রাখলেন। তারা নাম মাত্র মূল্যে বুকিং দিয়ে রেখে দিলো। শেষ পর্যন্ত চড়া দামে কিছু বিক্রি করলো। বাকীগুলো শেষ মুহূর্তে বিমানকে ফেরত দিয়ে দিলো। এ অবিক্রীতগুলো পরে আর বিক্রি করা যায় না। আবার ডিজিটাল পদ্ধতিতে এখন বিমান টিকেট বিক্রি করলেও এই সিস্টেমটাও ম্যানিপুলেশনের সুযোগ আছে।
এভিয়েশন বিষয়ক বিশ্লেষক কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, প্রযুক্তি হওয়ার সুবিধা যেমন হয়েছে, তেমনি কারসাজির নতুন নতুন আইডিয়া বের হচ্ছে। বিমানের ভেতর ও বাইরে থেকে কিছু ব্যক্তি সুচতুরতার সাথে টিকেট নিয়ে কারসাজি করে যাচ্ছে। টিকিট থাকা সত্ত্বেও না পাওয়ার অভিজ্ঞতা তারও রয়েছে। কিন্তু কারা এই কারসাজি করে – এমন প্রশ্নের জবাবে ড. এম এ মোমেন বলছেন ‘একটি টিকেট মাফিয়া’ চক্র এটি করছে।
ড. মোমেন বলেন, নিজেদের লোক জড়িত না থাকলে তো এটি সম্ভব হতো না। আমি নিজেও এমডি থাকার সময় চেষ্টা করেছি। এখন নতুন এমডি ব্যবস্থা নিতে পারলে খুবই ভালো। আসলে একটি ক্র্যাকডাউন চালিয়ে প্রভাবশালী চক্রটি ভেঙ্গে দিতে হবে।
বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান অবশ্য গত ১৩ই জুন জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন যে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের টিকেট যাত্রীরা বিমানের নিজস্ব ওয়েবসাইট, জিডিএস, মোবাইল অ্যাপ, কল সেন্টার এবং বিমানের নিজস্ব বিক্রয় কেন্দ্র ছাড়াও যে কোন অনুমোদিত দেশি-বিদেশি ট্র্যাভেল এজেন্ট থেকে ক্রয় করতে পারেন।
মন্ত্রী বলেছেন, কোনও এজেন্সি চাইলেই যাত্রীর তথ্য ছাড়া কোনও টিকেট বুকিং করতে পারবে না। সেই সাথে কোন এজেন্সি মিথ্যা বা ভুয়া তথ্য দিয়ে বুকিং করলে, সেটি ধরে জরিমানাসহ অন্যান্য পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়। এছাড়াও প্রতিটি টিকেটে বুকিং সময়সীমা দেয়া থাকে, যার মধ্যে টিকেট ক্রয় সম্পন্ন না হলে, সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যায়।
যদিও বাস্তবতা হলো, এতো সব নিয়ম কানুনের মধ্যেই টিকেট নিয়ে নানা ধরনের কারসাজির খবর আসছে নানা মাধ্যমে।
ট্রাভেল এজেন্টরা কে কী বলছেন
ট্রাভেল এজেন্সির মালিকদের সংগঠন আটাবের প্রেসিডেন্ট আব্দুস সালাম আরেফ বলেছেন, বিমানের এমডির আগে জানা দরকার এ সমস্যার উৎস কোথায়, কারা একে জিইয়ে রেখেছে এবং কারা এ থেকে লাভবান হয়।
তাদের তো জিডিএস দিয়ে মনিটর করার কথা। একজন বুকিং দিলেও কত সময় থাকবে। কীভাবে ক্যান্সেল করা হচ্ছে। কারা করছে। এগুলো তো মনিটর করার কথা। ভিন্ন ধরনের কিছু থাকলে তারা তো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বুকিং বাতিল করতে পারেন, যোগ করেন সালাম আরেফ।
তার মতে টিকেট নিয়ে এই সংকটের দায় বিমানের, কারণ বুকিং তো কন্ট্রোলারের হাতে তাকে। কেউ যদিও টিকেট ব্লক করে রাখে সেটা বাতিলের দায়িত্ব তো তার। আর এজেন্সির কাছে গ্রাহক আসলে বুকিং দেয়া হয়। একই গ্রাহক একাধিক এজেন্সিতেও বুকিং দিতে পারেন। ডাবল বা ডুপ্লিকেট বুকিং পরে বাতিল হয়।
আটাব প্রেসিডেন্ট মনে করেন ‘সর্ষের মধ্যে ভূত’ অর্থাৎ বিমানের মধ্য থেকেই কারসাজি হয়। যে কারণে এ সংকটের সমাধান হচ্ছে না।
আগে দায়ী করা হতো যাত্রীদের
বিমানের আসন খালি থাকা সত্ত্বেও বুকিং না পাওয়ার বিষয়টি আগেও অনেকবার আলোচিত হয়েছে। ২০১৮ সালে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছিলো। তখন বিমান সিট খালি থাকার দোষ চাপিয়েছিলো যাত্রীদের ওপর। কমিটির কাছে দেয়া জবাবে বিমান বলেছিলো অনেক সময় যাত্রীরা সময়মতো বিমানবন্দরে পৌছাতে পারেন না, শেষ মূহুর্তে অনেকে ভ্রমণ বাতিল করেন আবার শেষ মুহূর্তে ভিসা না পেয়ে বুকিং বাতিলের কারণেও কিছু আসন খালি থাকে।
আবার টেকনিক্যাল কারণে কখনো উড়োজাহাজ পরিবর্তন করে অপেক্ষাকৃত বেশী আসনের বিমান চালাতে হয় এবং সে কারণে দেখা যায় কিছু আসন খালি থাকছে।
তবে তখন বিমানের এসব যুক্তি গ্রহণ করেননি কমিটির তখনকার সভাপতি মুহাম্মদ ফারুক খান, যিনি এখন ওই মন্ত্রণালয়েরই মন্ত্রী। যদিও ১৩ জুন একই সংকটের বিষয়ে আসা প্রশ্নের জবাবে সংসদে তিনি বলেছেন, আসন খালি থাকা সত্ত্বেও টিকেট কিনতে গেলে বলে টিকেট নেই, এটি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে একটা ঢালাও অভিযোগ।