এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুর, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, সাইপ্রাস ও অন্যান্য দেশে এক বিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগের অনুসন্ধান করছে দুদক।
দেশের আলোচিত শিল্প গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের মালিক মো. সাইফুল আলম তার সম্পদ ও বিনিয়োগ নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বাংলাদেশের সরকারকে ছয় মাসের সময় বেঁধে দিয়েছে। এরকম একটি খবর দিয়েছে ব্রিটিশ পত্রিকা ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস। ওই খবর অনুযায়ী প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার কাছে পাঠানো সেই নোটিশে তিনি ওই সময়ের মধ্যে বিষয়টির সমাধান না হলে আন্তর্জাতিক সালিশিতে যাবেন বলেও জানিয়েছেন।
নোটিশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে ‘ভীতি প্রদর্শনমূলক ব্যবস্থা’ নিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে সিঙ্গাপুরের নাগরিক হিসেবে ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ চুক্তির আলোকে তার সুরক্ষা প্রাপ্য বলে দাবি করেছেন এস আলম।
এর আগে গত নভেম্বরে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেয়া এক চিঠিতে তার গ্রুপের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভুল ও মানহানিকর দাবি করে তারা ‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সালিশি মামলা করতে পারেন’ বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এস আলমের নোটিশ অনুযায়ী ছয় মাসের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার তার সাথে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রস্তাবে সাড়া না দিলে তিনি ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনাল কিংবা তার সাথে বাংলাদেশ সরকারের সম্পাদিত চুক্তিতে তৃতীয় কোনো দেশের আরবিট্রেশন সেন্টারের কথা উল্লেখ থাকলে সেখানে যেতে পারেন।
“বাংলাদেশ সাড়া না দিলে তিনি একাই ট্রাইব্যুনালে যেতে পারেন। সেখানে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের আইনজীবীরাও বলার সুযোগ পাবেন যে এস আলম গ্রুপ বাংলাদেশ থেকে কীভাবে অর্থ পাচার করেছে,” বলছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জাফরুল হাসান শরীফ।
গত অক্টোবরে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছিলেন এস আলম গ্রুপ প্রায় এক হাজার কোটি ডলার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশের একটি আদালত ইতোমধ্যেই সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ১২৫টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করেছে।
আন্তর্জাতিক সালিশি কী?
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জাফরুল হাসান শরীফ বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক সময় সম্ভাব্য বিরোধ নিষ্পত্তি কীভাবে হবে সেটি বিনিয়োগ চুক্তিতে উল্লেখ থাকে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত যাতে আসে সেজন্য চুক্তিতে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য তৃতীয় কোনো দেশের আরবিট্রেশন কোর্ট বা সেন্টারের নাম থাকে।
আবার ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনাল আছে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে। এক দেশের সাথে আরেক দেশের কিংবা দেশের সাথে বিদেশি কোম্পানির কিংবা বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো পক্ষ সংক্ষুব্ধ হলে তারা ট্রাইব্যুনালে যেতে পারে।
জাফরুল হাসান শরীফ বলছেন, সিঙ্গাপুরের সাথে বাংলাদেশ সরকারের বিনিয়োগ চুক্তিতে আরবিট্রেশনের প্রভিশন থাকলে সিঙ্গাপুরের কোনো নাগরিক বা নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে আরবিট্রেশন বা সালিশির প্রস্তাব দিতে পারে।
“কিন্তু দুই দেশের বিনিয়োগ সংক্রান্ত চুক্তিতে তেমন কিছু না থাকলে এস আলমের নোটিশের আইনগত কোনো ভিত্তি থাকবে না,’ বলছিলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলছেন, দুই দেশের মধ্যে ট্রেড বা ব্যবসা বাণিজ্য বিষয়ে কোনো সমস্যা হলে কিংবা কোনো পক্ষ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম নীতির বাইরে গেলে তা নিয়ে সংক্ষুব্ধ পক্ষ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় প্রতিকার চাইতে পারে।
“এটা কোম্পানি টু কোম্পানি কিংবা কোম্পানি টু সরকার- উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বিভিন্ন দেশের আরবিট্রেশন কোর্টগুলো আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে এসব বিরোধ নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে,” বলছিলেন ড. মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম।
এস আলমের নোটিশ: এরপর কী?
ড. মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলছেন, আরবিট্রেশন কোর্টে বাংলাদেশ সরকার অংশ নিলে তাতে যে সিদ্ধান্ত বা রায় আসবে সেই রায় সবসময় মানার বাধ্যবাধকতা নেই।
“এ ধরনের সিদ্ধান্ত স্ট্রিক্টলি ইনফোর্স করা কিংবা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা কঠিন। ধরুন একটা দেশের সাথে একটা কোম্পানির বিরোধ হলো। আরবিট্রেশনের সিদ্ধান্ত দেশের বিরুদ্ধে গেলো। কিন্তু সেই দেশ সেটি বাস্তবায়ন না করলে কী করার আছে! যদি বড় ধরনের কোনো চাপ আসে তখন আলাদা কিছু হতে পারে,” গণমাধ্যমকে বলেন তিনি।
মনিরুল ইসলাম বলেন, কোনো বিদেশি বাংলাদেশে আইন বহির্ভূত কিছু করলে তিনি তখন বাংলাদেশর আইনের আওতায় চলে আসবেন। আবার কোনো বাংলাদেশি যদি অন্য কোনো দেশে গিয়ে অপরাধ করে তাহলে তার বিরুদ্ধে সেই দেশের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে।
“অন্যদিকে আরবিট্রেশনের রায় আপনার পক্ষে গেলেও দিন শেষে সেটা বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব,” বলছিলেন তিনি।
জাফরুল হাসান শরীফ বলছেন, এস আলমের নোটিশের জবাব যদি বাংলাদেশ সরকার না দেয় অর্থাৎ বিরোধ নিষ্পত্তির প্রস্তাবে যদি সায় না দেয় তাহলে এস আলম গ্রুপ একাই ট্রাইব্যুনালে যেতে পারে।
“সেখানে সরকার না গেলে তখন ট্রাইব্যুনাল একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেটা দেশের জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে। তাই বরং সরকার জবাব দিতে সেখানে গিয়ে এস আলমের বিরুদ্ধে টাকা পাচারের যে দাবি করে আসছে সেটি অভিযোগ আকারে তুলে ধরতে পারে,” বলছিলেন তিনি।
তার মতে, সিঙ্গাপুর বা যুক্তরাজ্যের মতো দেশে অন্য কোনো দেশ থেকে অবৈধ পথে অর্জিত অর্থ ভিন্ন পথে বিনিয়োগে আইনি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
“সে কারণে এস আলম ট্রাইব্যুনালে গেলে সেটি বাংলাদেশ সরকারের জন্য সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তোলার একটি সুযোগ নিয়ে আসতে পারে,” বলছিলেন জাফরুল হাসান শরীফ।
সুপ্রিম কোর্টের আরেকজন আইনজীবী তার নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেছেন, এস আলম গ্রুপ আরবিট্রেশনে গেলেও খুব একটা লাভ পাবে না বলেই মনে হয়। কারণ আরবিট্রেশনের রায় কোনো পক্ষ বাস্তবায়ন না করলে কার্যত করার কিছুই নেই। কোনো বিদেশি বা বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা সরকারের কারণে তার সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশের আদালতেই তার প্রতিকার চাইতে হবে।
প্রসঙ্গত, এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম সিঙ্গাপুরের নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছেন বলে তার নোটিশে উল্লেখ করেছেন।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী- বাংলাদেশ সরকারকে দেয়া নোটিশে বলা হয়েছে যে, সাইফুল আলমের পরিবার ২০১১ সাল থেকে সিঙ্গাপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তারা সে দেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন।
একই সাথে নোটিশে তারা জানিয়েছেন যে, সাইফুল আলম ও তার পরিবার ২০২০ সালে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন।
গত অক্টোবরে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরকে উদ্ধৃত করে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো, “ডিজিএফআইয়ের (বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা) সহায়তায় কয়েকটি ব্যাংক দখলের পর ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলমের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তার সহযোগীরা ‘অন্তত’ ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি ডলার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বের করে নিয়েছেন।”
পরে এস আলমের পক্ষে তার আইনি প্রতিষ্ঠান কুইন এমানুয়েল আরকুহার্ট অ্যান্ড সুলিভান এক বিবৃতিতে বলেছিলো “এসব অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই”।
এর মধ্যেই গত উনিশে ডিসেম্বর বাংলাদেশের আদালত সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ১২৫টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছে।
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আদালতকে জানিয়েছে, “এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুর, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, সাইপ্রাস ও অন্যান্য দেশে এক বিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগের অনুসন্ধান করছে দুদক।”
এর ঠিক আগের দিনই এস আলমের পক্ষ থেকে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ছয় মাসের সময় দিয়ে এর মধ্যে সমাধান না হলে আন্তর্জাতিক সালিশিতে যাওয়ার কথা জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে নোটিশ দেয়ার খবর দেয় ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকা।
এছাড়া এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ তদন্ত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।