উনিশ শ ষাটের দশকের সেই সময় গুটিবসন্ত মহামারি আকার নিয়েছিল এ দেশে। সে সময় তিন বছরের ব্যবধানে দেশে সোয়া লক্ষ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং মারা যায় প্রায় ছিয়াশি হাজার মানুষ। এরপর দেশে গুটিবসন্ত নির্মূলে টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়।
সেই সময়ের এক আষাঢ় মাসের পয়লা তারিখ। আষাঢ় মাস হলেও সেদিন গোটা আকাশটা ছিল অবিশ্বাস্য রকমের ঝকঝকে তকতকে। কোনো মেঘ নেই বললে অবশ্য ভুল বলা হবে। লোহার পাতের মতোন একফালি কালো মেঘ উত্তর-পশ্চিম আকাশে ঝুলছিল। মনে হচ্ছিল এটি যেন নির্মল আকাশের কপালে অনাকাঙ্খিত এক কলংক-তিলক। ঠিক এ টুকুই। সামান্য ওই কালোমেঘ বর্ষার প্রথম দিনের আকাশের গায়ে ভয়ের রেখা টানতে পারেনি। ভয়ের কথা আসছে এ কারণে যে, যে বছরের কথা বলছি, তার আগের বছরই এমন আষাঢ় মাসেই গোপালপুরের কয়েকটি ইউনিয়নের পুরোটা এলাকায় ভয়াবহ টর্নোডো আঘাত হেনেছিল। সেদিন অবশ্য আকাশভরা কালোমেঘের জঙ্গল ছিল। মূহুর্মূহু বজ্রপাতের গর্জনও ছিল। ছিল দিনের বেলাতেই চারদিক অন্ধকার করা তুমুল বর্ষণ। আকাশের সেই কালো মেঘগুলো থেকে হাতির সুড়ের মতো কুণ্ডলী নেমে এসে এলাকার কয়েকটি ইউনিয়নের গ্রামের পর গ্রাম লন্ডভন্ড করে দিয়ে গিয়েছিল। মানুষ মরেছিল বেশুমার।
একদিকে গুটি বসন্তের বিভীষিকা, আরেক দিকে টর্নোডোর আতঙ্ক। ভয়াল টর্নোডোটি ছোবল হেনেছিল বিকেল বেলায়। দূর থেকে বাতাসের ঘূর্ণিতে উড়তে থাকা গাছের পাতা আর কাগজের টুকরার মতো যে জিনিসপত্রগুলো দেখা গিয়েছিল— পরে জানা গিয়েছিল সেগুলো ছিল জীবন্ত মানুষ, ঘরের আসবাবপত্র, কাপড়-চোপড়, চালের টিন আর গাছপালা-ঝোপ জঙ্গল। দু-চার-দশ কিলোমিটার দূর থেকেও দৃশ্যটি দেখা গিয়েছিল। সেদিনকার লু-হাওয়া যার শরীরে লেগেছিল সে-ও অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। ওই ঘটনার পর থেকে গ্রামের মানুষজন বিশ্বাস করা শুরু করে, শুধু চৈত্র, বৈশাখ আর জৈষ্ঠ মাসই নয়, আষাঢ় মাসেও তুফান হয়। কিন্তু আষাঢ় মাসের যে পয়লা দিনটির কথা বলছি, সেদিন আকাশের ওই তলোয়ারের মতো এক ফালি কালো মেঘ সেই ভয় ছড়ানোর মতো মনে হচ্ছিল না যদিও।
সেই বছর পয়লা আষাঢ়ের এক দুপুর বেলা গোপালপুরের বনমালী গ্রামের মধ্যবয়সী ফেরিওয়ালা শমসের বেপারি তার স্ত্রী ফুলজান বেগমকে গঞ্জে পাঠানোর জন্য মনস্থির করল| তাদের একমাত্র পুত্রসন্তান রহমত বেপারিকে গুটি বসন্তের টিকা দিতে হবে। গত বছরই গ্রামে গুটিবসন্তের মড়ক লেগে অনেক মানুষ মারা গিয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের জন্য গুটিবসন্ত এক আতঙ্কের নাম। শুধু বনমালী গ্রাম নয়; আশপাশের অন্য গ্রামগুলো থেকেও খবর আসছে গুটিবসন্তের। বসন্তের ভয়ে হাটবাজার প্রায় জনশূণ্য হয়ে পড়েছে। তাই শমসের বেপারি আর দেরি না করে দুই বছর বয়েসী সন্তান রহমতকে টিকা দিতে সেদিন গোপালপুর সদর হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করল। স্ত্রীকে সে কয়েকদিন ধরে তাগাদা দিচ্ছিল, নানা কাজের ব্যস্ততায় ফুলজানের যাওয়া হয়নি। তাই সেদিন আষাঢ়ের এক তারিখ সকাল বেলাতে শিশুপুত্রকে নিয়ে গোপালপুরের গঞ্জে পাঠানোর পরিকল্পনা করল।
বনমালী দক্ষিণপাড়ার চানু মাঝি নামকরা নৌকা চালক। লোকে বলে—চানু মাঝি, ঝানু মাঝি। তারই নৌকাতে বিশ টাকা যাওয়া-আসার ভাড়ায় সব মিটমাট করা হয়েছে। চানু মাঝির বাড়ির ঘাট থেকে সকাল বেলা নৌকা ছেড়েও দিল।
সমশের বেপারি শাড়ি-চুরির ফেরিওয়ালা। তার ফেরির বাক্সে শাড়ি-চুড়ি ছাড়াও আরো থাকে চুলের নানা রঙের ফিতা, গায়ে মাখার সুগন্ধি তেল, আলতা-স্নো-পাউডার, গায়ে মাখা সাবান, কাপড় কাঁচার সোডাসহ নানা কসমেটিকস উপকরণ। তার ফেরির বাক্স যেন ভ্রাম্যমান এক কসমেটিকসের দোকান। সে মাসের প্রতিদিনই সকাল বেলা ফেরি করতে গাঁওয়ালে বের হয়। এদিনও স্ত্রী-সন্তানকে বিদায় দিয়ে গাঁওয়ালে যাওয়ার জন্য ঘরের দাওয়ায় বসেছিল। দুপুর বেলা স্ত্রী-সন্তান যখন নৌকায় উঠল, সমশের বেপারী তখন ফেরির বাক্স ঘাঁড়ে তুলে নিল। এগুলো এখন সে ফেরি করতে দূর-দূরান্তের দশগাঁয় যাবে। এই ফেরি নিয়ে না গেলে যে দিন এনে দিন খাওয়া তার অভারের সংসারে সেদিন ভাতের চুলা জ্বলবে না। এ কারণেই তিনি গঞ্জে না গিয়ে বউকে পাঠাল।
শমসের ব্যাপারি। গ্রামের মধ্যবয়সী এই লোকটির বংশ পরম্পরায় পেশা এই ফেরি করা। এই খুদে ব্যবসাতেই তার সংসার দিব্যি চলে যায়। পার্শ্ববর্তী গাঁয়ের আরেক ফেরিওয়ালার মেয়ে ফুলজান বেগমকে সে বিয়ে করেছিল সেই বিশ বছর আগে। ফুলের মতো দেখতে ফুলজান গায়ে-গতরে কিন্তু সুঠাম। এ যুগের নারী বাস্কেটবল খেলোয়াড়দের মতোই পেটা ও লম্বাটে শরীর এই পাড়াগাঁর মেয়েটির। খেলাধূলার সুযোগ পেলে এই ফলুজান কোনো একদিন জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলে বিজয় মালা ছিনিয়ে আনতেও পারত। সেই ফুলজানকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল স্থানীয় অনেকেই। কিন্তু ভাগ্যের শিকে ছিড়েছিল দরিদ্র শমসের ব্যাপারীর কপালেই। ফুলজানের বাবা কারো ওপর ভরসা পাননি। তা-ই কন্যা তুলে দিয়েছিলেন ফেরিওয়ালা শমসেরের হাতে।
সেই ফুলজানকে নিয়ে শমসেরের সংসারে সুখ-শান্তির কমতি ছিল না। কিন্তু একটিই তাদের অভাব ছিল—বিয়ের বিশ বছর পরেও তাদের কোনো সন্তান-সন্তুতি ছিল না। অনেক ডাক্তার, কবিরাজ দেখিয়েও কিছুতেই কিছু না হওয়ায় সন্তানের আশা অনেকটা ছেড়েই দিয়েছিল সমশের-ফুলজান দম্পতি। জীবনে এই অপ্রাপ্তিটুকু ছাড়া আর কোনো খেদ ছিল না তাদের। লোকে আটকুঁড়ে বলত, গায়ে মাখত না শমসের বা ফুলজান কেউই। দীর্ঘদিন কথাটি শুনতে শুনতে যেন গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল তাদের।
এরইমধ্যে একদিন শমসের ব্যাপারী গোপালপুর বাজারে গিয়েছিল। সেখানেই কথাপ্রসঙ্গে জামতৈল গ্রামের দর্জি দবির উদ্দিন তাকে বলছিল ভারতের আজমীর শরিফের কথা। সেখানে গিয়ে আল্লাহর দরবারে একান্তমনে প্রার্থনা করে নাকি জামতৈল গ্রামের হাসমত আলীর স্ত্রী ৩০ বছর পর সন্তান লাভ করেছে! শুনে শমসের ব্যাপারী পারলে সেদিনই আজমীর রওয়ানা দেয়। পরে অবশ্য সে স্থানীয় আদম ব্যবসায়ীদের ধরে আজমীর গিয়েছিল। সেখান থেকে আসার পর আজমীরের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল খেটে খাওয়া সমশের। কিন্তু মাস ছয়েক পর ফুলজান বেগম একদিন সকালে তার স্বামীকে ডেকে যখন সেই মহাখুশির সংবাদটি দিয়েছিল, শমসের যেন সেদিন বিশ্ব জয় করে ফেলেছিল। সে না কি বাবা হতে যাচ্ছে! পৃথিবীতে বোধ হয় প্রাণের আগমনের সংবাদের চেয়ে বড় কোনো সুখের সংবাদ হয় না। কোনো কিছু সৃষ্টির সংবাদই বোধ হয় সেরা সংবাদ।
জীবনে এরচে আর বড় কি সংবাদ হতে পারে শমসেরের জীবনে? কিছুই না। আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল শমসের। স্থানীয় মসজিদে শিরনী দিয়েছিল সেদিনই। বউয়ের প্রতি এমনিতেই যত্নশীল শমসের এরপর থেকে যত্নটা আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। ছেলে হোক আর মেয়ে— তার আটকুঁড়ে অপবাদটা ঘুচবে, এই আনন্দে দিশেহারা সে। বংশের প্রদীপ জ্বালাবার কেউ একজন যে আসছে, তা ভেবে সে বারবার শিহরিত হচ্ছে। কয়েকদিন ত সে আনন্দের চোটে ঘুমাতেও পারেনি। কোটি টাকার লটারি জেতার পর দরিদ্র মানুষ যেমন মহা আনন্দে ঘুমাতে পারে না, তেমন দশাই হয়েছিল শমসেরের। শমসেরও অনাগত সন্তানের আগমনের আনন্দে তখন ঘুমাতে পারেনি। জগতে অতি কষ্টে আর অতি আনন্দে মানুষের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। শমসেরেরও তা-ই হয়েছিল। বউকে ওই সময় সে সারারাত নানা মজার মজার গল্প শুনিয়ে কাটাত। পরদিন সকালে ঘুমটলমল চোখ নিয়ে টলতে টলতে স্বামীর ফেরি নিয়ে গাঁওয়ালে যাওয়ার দৃশ্য দেখে ফুলজান মুগ্ধ হয়েছে। যে মুগ্ধতার আসলে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব।
সেই বহু আরাধ্য সন্তানকে নিয়ে ফুলজান আজ নৌপথে গোপালপুর যাচ্ছে। নদীপথে বনমালী থেকে গোপালপুরের দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। যার ১০ কিলোমিটারই পাড়ি দিতে হয় বিস্তৃর্ণ একটি বিল। বিলের নাম হেলেঞ্চা বিল। বড় মায়াময় এক বিল। নানা রঙের শাপলা-শালুক আর হেলেঞ্চা সবজির জন্য এর সুখ্যাতি আছে। এমনিতে প্রশান্ত ওই বিলটি ঝড়ের সময় কেমন যেন অচেনা হয়ে যায়। বিলের কালো জল তখন আরো ভয়ঙ্কর কালো রঙ ধারণ করে। তখন হেলেঞ্চা বিলের বিশাল কালো জলরাশি ষাড় গরুর কুচকুচে চোখের মতোন হয়ে যায়।
বিলের এক পাড়ে দাঁড়িয়ে অন্য পাড় দেখা যায় না। বিলের দক্ষিণে মাদারজানি গ্রাম, পশ্চিমে নবগ্রাম, উত্তর গোয়ালপাড়া আর পুবদিকে চরপাড়া-ভূয়ারপাড়া। আকারে বিশালতার জন্য স্থানীয়রা ওই বিলকে ডাকে গহীন সমুদ্দুর বলে। বর্ষায় এই সমুদ্দুর সাগরে রূপ নেয়। ঝড় না থাকলে এই বিল খুবই প্রশান্ত আর মমতাময়ী। কিন্তু ঝড় উঠলে এই বিলকেই মনে হয় অপরিচিত কোনো রাক্ষুসে বিল। সবকিছু যেন গিলে খেতে চায় সে। ঝড়হীন হেলেঞ্চাবিল মানেই মমতাময়ী এক মা, আর ঝড়ের হেলেঞ্চা বিল যেন অত্যাচারী এক সৎ-মায়ের প্রতিভূ।
উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ঝিনাই নদীর শাখা আত্রাই নদী এসে এই বিলে মিশেছে। ঝিনাইয়ের পানির উৎস বিখ্যাত যমুনা নদী। ওদিকে বিলের পূর্বদিকের মাথায় এসে যুক্ত হয়েছে বৈরাণ নদী। মূলত এই বিলের মধ্যে দিয়ে নৌপথে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় লক্ষ লক্ষ মানুষের যাতায়াত হয় গোপালপুর সদরে।
গোপালপুর প্রতিদিনই বাজার বসে। তবে হাট বসে শনি ও বুধবার। এই হাট বহু প্রাচীণ। শোনা যায়, জেলা ত বটেই, এমনকি খুলনা, বরিশাল, নোয়াখালী, চাঁদপুরের মহাজনরাও বড় বড় নৌকা নিয়ে এই হাটে আসেন। নদীপথই এলাকার প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম। সেই নদীপথেই আষাঢ়ের পয়লা দিন ফুলজানকে সন্তানসহ গোপালপুরের গঞ্জে পাঠাল শমসের। সে নিজেও বেরিয়ে পড়ল ফেরির বাক্সপ্যাটরা মাথায় নিয়ে অজানা পাড়াগাঁর উদ্দেশ্যে। যাওয়ার সময় বারবার সতর্ক করে দিল, ঝড়ের সময় নদীপথ ভয়ঙ্কর হয়। তাই যদি ঝড় উঠে নৌকায় রহমতকে যেন সে ভাল ক’রে দেখেশুনে রাখে।
এই বিল দিয়ে ঝড়ের সময় নৌকা এমনকি লঞ্চ চালানোও কঠিন। তাই পারতপক্ষে কোনো যাত্রীবাহী নৌকা, কিংবা কোনো লঞ্চ ঝড়ের সময় ওই বিল দিয়ে যাওয়ার সাহস করে না। একবার ত বরিশালের একটি পণ্যবাহী লঞ্চ ডুবে গিয়েছিলে এই বিলে। পুরো বর্ষা মৌসুমে সেটি আর উদ্ধার করা যায়নি। পরে শীত মৌসুমে পানি কিছুটা কমে এলে লঞ্চটির ধংসাবশেষ উদ্ধার করা হয়েছিল। সঙ্গে হতভাগা যাত্রীদের কিছু কঙ্কালের অবশিষ্টাংশ। ওই লঞ্চ দুর্ঘটনা ছাড়াও কতো মাঝির নৌকা যে খেয়েছে হেলেঞ্চা বিল, তার হিসাব নেই। হতভাগ্য সেই নৌকার যাত্রীদের কংকালগুলো এখনো হয়ত পড়ে আছে বিলটির গহীনে মৃত্যুহিম করা কুচকুচে পানির তলায়। সেসব কংকালকে হয়ত এখন খেলাধুলার ঘর বানিয়েছে নানা রকমের সরিসৃপ আর রাক্ষুসে মাছের পোনারা।
হেলেঞ্চা বিলের ঝড়ে ফুলে উঠে তার কালোজলরাশি। মরা মানুষগুলোর আত্মারা ঝড়ের সময় পানির অতল গহীনের প্রেতরাজ্য থেকে উঠে আসে। ফেনায় ফেনায় উন্মত্ত প্রেতাত্মারা সেসব আত্মার সঙ্গে নেচে উঠে তখন। প্রেতাত্মাদের শায়েস্তা করতে আকাশ থেকে বজ্রপাত হয়। কিন্তু বজ্রপাতের সেই বিদ্যুত নিয়েও অবলীলায় খেলা করে অশরীরী সেই আত্মারা। তখন দুই পক্ষের এই লড়াইয়ে হেলেঞ্চা বিলের মায়াবী রূপ বিভৎসতায় রূপ নেয়। দুর্যোগের সময় অনেক পাকা মাঝিও তখন দিশা হারিয়ে ফেলে। বিলডগা গ্রামের সিদ্দিক মাঝি সেই ভয়াল রূপ একবার দেখেছিল। এরপর থেকে তার মাথার সেই যে গণ্ডগোল দেখা দিল, তা আর সারানো যায়নি। এখনো সিদ্দিকের মাথা ঠিক হয়নি। গ্রামের কোথাও আড্ডা বা জমায়েত দেখলেই সিদ্দিকের মাথার গণ্ডগোলটা চেগাড় দিয়ে উঠে। সে তখন জমায়েতের মাঝখানে গিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে— তাড়াতাড়ি নৌকা চালাও মাঝি! ভাগো! ওই আইল! তোমাগোরে খাইয়া ফালাবো! ওই যে আইলো! ওই! সাবধান! সাবধান মাঝি!!
লোকজন জানে সিদ্দিক মাঝি সত্য বলতেছে। তারপরও তারা তার কথায় গুরুত্ব দেয় না, হেসে উড়িয়ে দেয়।
সেদিনকার আকাশের পরিস্থিতি ভাল দেখে ফুলজান তার দুই বছরের ছেলে রহমতকে নিয়ে সকাল বেলা বনমালী গ্রাম থেকে গোপালপুর রওয়ানা হল। নৌকায় এলাকার আরও জনপাঁচেক যাত্রী ছিল। এদের মধ্যে বনমালীর উত্তরপাড়ার মাঝবয়েসি তফাজ্জল ফকির, যুবক লতিফ, দক্ষিণপাড়ার দোকানি করিম শেখ, রহিমদ্দি আর জালাল উদ্দিন। যাত্রীদের নিয়ে চানু মাঝির নৌকা দুপুরেই পৌঁছে গেল সদরে। এরপর সবাই যারযার মত বাজার-ঘাট করার জন্য ছড়িয়ে পড়ল। ফুলজান গেল সদর হাসপাতালে। সেখান থেকে রহমতকে টিকা দিয়ে নিয়ে এসে আবার নৌকায় ফিরে এসেছে ফুলজান। মনটা তার আজ ভীষন ফুরফুরে। ছেলেকে টিকা দিতে পেরেছে সে। বড় আরাধনায় পাওয়া এই সন্তান। গুটিবসন্তের মড়ক আর তার সন্তানকে ছুঁতে পারবে না। এরমধ্যেই অন্য যাত্রীরাও বাজারঘাট করে তাড়াতাড়ি নৌকায় ফিরে এল। সবাই নিরাপদে সকাল সকাল বাড়ি ফিরতে চায়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। চানু মাঝি আর দেরি করল না। নৌকা ছেড়ে দিল বনমালীর উদ্দেশ্যে।
বর্ষার আকাশ বড় রহস্যময়। এই পরিষ্কার ত, কিছুক্ষণের মধ্যে কালোমেঘে সেজেগুজে রুদ্রমূর্তি। চানু মাঝি এ নিয়ে খুব একটা ভাবিত হল না। তার ছোট্ট নৌকার নতুন বাঁশের মাচা। সেই মাচার মাঝখানে বসেছে ফুলজান। তার কোলে শিশু রহমত। কালো পানি কেটে সাপের মতো তরতর করে ছুটে চলেছে চানু মাঝির নৌকা। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু নৌকা মাঝ বিলে আসার পর ঘন্টাখানেকের ব্যবধানেই আকাশ একেবারে অন্ধকারে ছেয়ে গেল! এমন অন্ধকার যে মনে হচ্ছে এই বিকেল বেলা ঘোরসন্ধ্যা নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে!
রাতের বেলা আঁধার নামলে মানুষের ভয় লাগে না। কিন্তু দিনের বেলা রাতের আঁধার নেমে এলে ভয়ের আর সীমা থাকার কথা নয়। তারওপর যদি তীব্র বজ্রনিনাদ আর বিজলীর চমকানি যোগ হয়— তাহলে ত কথাই নেই। চানু মাঝি সাহসী মানুষ। চানু মাঝির সঙ্গের যাত্রীরাও অদম্য সাহসী। এরা সবাই দুই চার পাঁচ মাইল সাঁতরানোর মানুষ। যমুনা নদীতেও তারা মাঝেমধ্যে সাঁতার কাটতে নামে। ফলে ভয় তাদেরকে কাবু করার কথা নয়। কিন্তু তারাও আজ ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল। এ কি বিভৎস রূপ আজ হেলেঞ্চা বিলের!
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল বাতাসের সোঁ সোঁ গর্জন। এ যেন গর্জন নয়, কোনো রাগান্বিত বিষাক্ত নাগিনীর দংশন করবার অভিপ্রায়ে একাধারে ফোঁসফোঁসানি। হেলেঞ্চা বিলের কালো জলের গহীন থেকে অশরীরী সেই আত্মারা এবার উঠে আসতে শুরু করেছে। এরাই এখন মাতাল জলরাশির রূপ ধরে সবকিছু গ্রাস করার মতলব এঁটেছে। তারা ফুলে ফেঁপে উঠে ছোবল হেনে চলল বিপরীত থেকে আসা বাতাসের গায়ে। আর বাতাসও উন্মত্ত জলের ছোবল খেয়ে মরা মানুষের মতো গোঙাচ্ছে। যে বাতাস আজ উঠেছে, যে বজ্রনিনাদ চলেছে; তাতে নৌকা ডুবিতে মৃত্যু না হলেও বজ্রপাত থেকে বুঝি কারোরই নিস্তার নেই।
চানু মাঝি প্রাণপণে হাল ধরে রাখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু এমন ঢেউ আর বাতাসে হাল অকেজো হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। হলও তা-ই। ঝড় উঠবার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীরাও বৈঠা হাতে তুলে নিয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। এরইমধ্যে ৫-৬ ফুট উচু ঢেউগুলো নৌকার ওপর ভেঙে পড়তে লাগল। একবার ঢেউয়ের তোড়ে নৌকা দুই হাত আগায় তো পরের ঢেউয়ে ২০ হাত পেছনে নিয়ে যায়। একপর্যায়ে বিশাল উচু ঢেউগুলো নৌকার ওপর ভেঙে পড়তে লাগল। কাছে কোথাও ভয়াবহ এক বজ্রপাত হল। চোখ যেন জ্বলসে গেল নৌকার সব যাত্রীর। এখনই বুঝি পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাবে ক্ষুদ্র নৌকা আর তার মুষ্টিমেয় যাত্রীরা।
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। ও আল্লাহ মাফ কর আমারে’— আর্তচিৎকার করে উঠল তফাজ্জল ফকির। তার সঙ্গে সঙ্গে লতিফ, করিম শেখ, রহিমদ্দি আর জালালও কলেমা পাঠ শুরু করেছে। মৃত্যু হলে যেন তারা শেষবার কলেমা পাঠ করে যেতে পারে— তারই অন্তিম চেষ্টা।
নৌকার মাঝখানে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল ফুলজান। শাড়ির আঁচলের নিচে প্রিয় শিশুসন্তান রহমতকে আগলে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা করছে সে। রহমত যাতে বজ্রাপাতের ভয়াল শব্দে ভয় না পায় তার জন্য তার কানদুটো দুই হাতে সে আলতো ক’রে চেপে ধরে রেখেছে। মা মুরগি যেমন তার বাচ্চাগুলোকে শিকারী পাখির থাবা থেকে রক্ষায় ডানা দিয়ে আগলে রাখে, ফুলজানও যেন আজ তার একমাত্র সন্তানকে হেলেঞ্চা বিলের ভয়াল ঝড় থেকে রক্ষার শেষ সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
নৌকার গলুইয়ে এরমধ্যেই হাটু পানি হয়ে গেছে। উপর থেকে আকাশ ফুটো হয়ে ঝরছে বর্ষার মেঘ। বর্ষণের পানির সঙ্গে যোগ হচ্ছে ঢেউয়ের পানি— দুইয়ে মিলে নৌকায় পানি বেড়েই চলেছে। নৌকাটি এখন পেটফোলা শুশুকের মতো গড়াগড়ি খাচ্ছে। নৌকার যাত্রীরা বুঝতে পারল, এই নৌকা আর বাঁচানো যাবে না। নৌকা না বাঁচলে সেই নৌকায় বসে থাকা মানে মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করা। এর চেয়ে জীবন বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করাই তাদের কাছে উত্তম মনে হল।
বিক্ষুব্ধ জলে প্রথমেই ঝাপিয়ে পড়ল তফাজ্জল। তার দেখাদেখি অন্যরাও ঝাপিয়ে পড়ল বিলের নিকষ কালো জলে। চানু মাঝি কি করবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না। নিজের মূল্যবান নৌকা ছেড়ে জীবনের টানে হেলেঞ্চার জলে ঝাপিয়ে পড়বেন, না কি শেষ পর্যন্ত রয়ে যাবেন নৌকায়? তিনি জীবনে অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝাট দেখেছেন; কিন্তু আজকের এই ঝড়, ঠিক যেন ঝড় নয়— প্রাণ কেড়ে নিতে আসা মহাপ্রলয় যেন। নিস্ক্রিয় হাল দিয়ে নৌকা সামলাতে গিয়ে ঘেমে-নেয়ে একাকার হচ্ছেন তিনি। শরীরের সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসছে তার। আর হয়ত বেশিক্ষণ টিকতে পারবেন না তিনি। চোখে তিনি অন্ধকার দেখা শুরু করেছেন। কেন তার শরীর আজ নিস্তেজ হয়ে আসছে? দুই হাতের কব্জির অমিত সেই শক্তি কে আজ শুষে নিচ্ছে? তার অমিত সাহসে কে আজ ফাঁটল ধরাচ্ছে? আর কিছু ভাবতে পারলেন না তিনি।
নৌকার গলুইয়ের ওপর চানু মাঝি ঢলে পড়লেন। চারদিকে তার অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। চানু মাঝির একটি পৃথিবী ছিল। সেই পৃথিবীর তাবৎ বাস্তবতা দুঃস্বপ্নের ঘোরে হেলেঞ্চার কালো জলে আজ মিশে গেল।
ফুলজান মহা আতঙ্ক নিয়ে দৃশ্যটা দেখল। নৌকার যাত্রীরা প্রাণ বাঁচাতে বিলের পানিতে একে ঝাপিয়ে পড়া, মূহুর্তে মুহুর্তে বাজ পড়া, বিশাল বিশাল ঢেউয়ের আছড়ে পড়া— সবই দেখেছিল সে। তারপরও ঘাবড়ায়নি। এসব ঘটনায় সে ততোটা উদ্বীগ্নও হয়নি। কিন্তু ঝড়ের যমুনা নদীতে বুক চিতিয়ে নৌকা বাওয়া চানু মাঝির এমন পরিণতিতে ফুলজান আর আশার আলো পেল না। নৌকা এবার ঘোলাপানিতে দিকভ্রান্ত হওয়া ডানকানা মাছের মতোন টালমাটাল ঘুরতে লাগল। আর কিছুক্ষণের মধ্যে ডুবে যাবে এই নৌকা। যে নৌকার মাঝি নেই, সেই নৌকায় ভরসাও নেই। এতক্ষণ ফুলজান প্রাণপণে শিশুপুত্র রহমতকে বুকের কাছে শাড়ির আঁচলে পেঁচিয়ে রেখেছিল। এবার বুঝি জীবনের সব আশা তার ছেড়ে দিতে হবে। সে বোধ হয় রহমতকে আর বাঁচাতে পারল না। আল্লাহর দরবারে এরইমধ্যে কয়েক দফা প্রার্থনা করেছে সে, তারই রহমতে পাওয়া রহমতকে যেন তিনি বাঁচিয়ে দেন। তার অপার দয়ায় পাওয়া পুত্রের নাম ওর বাবা রেখেছিল রহমত। সেই রহমতকে যেন তিনি এই নামের উসিলাতে হলেও আজ রেখে যান। প্রয়োজনে তিনি যেন তার জীবনের সব আয়ু নিয়ে নেন। এই হেলেঞ্চা বিল যেন মায়াবতী হয়ে তার সন্তানটিকে রেখে যায়। হেলেঞ্চাবিল যেন আজ হেলেঞ্চাময়ী হয়ে উঠে।
দেখতে দেখতে চোখের সামনেই নৌকাটি ডুবে গেল। প্রথমে সামনের গলুই, এরপর খাড়াভাবে জলের অতলে যাত্রা শুরু করল চানু মাঝির সাধের নৌকা। ফুলজান বুঝতে পারল, এই নৌকায় আর আশা নেই। রহমতকে নিয়ে অকুলপাথারে ভাসতে হবে— তার প্রস্তুতি নিতে হবে। লড়তে হবে প্রচণ্ড ঢেউ আর আকাশের বজ্রবোমার সঙ্গে। ফুলজান তাই ডান হাত দিয়ে রহমতকে যতোটা সম্ভব উচু করে ধরে উপরে তুলে রাখল। আর বাম হাত দিয়ে প্রাণপণে সাঁতার কাটার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কোন দিকে যাবে সে? কোনদিকে স্থলের ঠিকানা?
প্রচণ্ড ঢেউ একবার ডুবিয়ে দিচ্ছে ফুলজানকে। আরেকবার ভাসিয়ে তুলছে। ফুলজান নদীপাড়ের কণ্যা। সে জানে কীভাবে নদীকে বশ মানাতে হয়। সে লড়ে চলেছে— নিজের প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানের জন্য, নিজের অস্তিত্বের জন্য। স্বামীর দেওয়া এক অমূল্য আমানত সুরক্ষার জন্য। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ পারবে সে? তার শরীর ত আর চলতে চাইছে না। তার দুচোখ জুড়ে কেন এতো ঘুম আসছে আজ? এ ঘুম কি তাহলে চিরঘুম? তাহলে কি রহমতকে সে বাঁচাতে পারবে না? সে ক্রমে ক্রমে আরো নিস্তেজ-নিথর হয়ে পড়ল। চানু মাঝির নৌকার চেয়েও বড় তার বুকের জমিন। চিৎ হয়ে এবার সেই বিশাল বুকে তুলে আনল রহমতকে। তাকে অভয় দিল সে। অবুঝ সন্তানকে বারবার শিশুর ভাষায় বুঝাতে লাগল, যদি সে এই বুকের ওপর নির্ভয়ে বসে থাকে, অনেক অনেক খেলনা কিনে দেওয়া হবে তাকে। অনেক অনেক আদর দেওয়া হবে তাকে। শিশু রহমত যেন আজ মায়ের সব ভাষা-ই বুঝতে পারছে। সে আর নড়াচড়া করল না। সুবোধ বালকের মত সেই মাতৃনৌকার পাটাতনে ঝড় শেষের অপেক্ষায় বসে রইল।
চারদিকে হঠাৎ শুনসান নিরবতা গ্রাস করল। পশ্চিম আকাশে মেঘের ফাঁক দিয়ে সন্ধ্যার সূর্যটা শেষবারের মত উঁকি দিল। একটু আগেও যে ঘোরতর অন্ধকার ছিল, তা কেটে কেটে গিয়ে আলোআঁধারির এক রহস্যময় দ্যেতনা তৈরি করল। এরইমধ্যে আকাশ থেকে নেমে এল ঘনকূয়াশার চাদর। চারদিক-চরাচর ঘিরে ফেলল সেই শ্বেতশুভ্র চাদর। ফুলজান সব দেখল। তার চোখের পলক আর পরছে না। সেই কূয়াশা ভেদ করে দূরে এবার দুটি নৌকা দৃষ্টিসীমায় এল। নৌকা দুটি ক্রমেই কাছে আসছে। এবার পরিষ্কার হল নৌকা দুটি। একটি কাঠের নৌকা, অন্যটি রূপার। নৌকা দুটি আসছে একই সঙ্গে। কোনোটি সামাণ্য আগে বা পরে নয়। যেন নৌকা দুটি একটি আরেকটির ছায়া।
কাঠের নৌকার যাত্রীরা ফুলজানের বুকে লেপ্টে থাকা রহমতকে কোলে তুলে নিল। তারা বলাবলি করতে লাগল— ‘আল্লাহর কি শান, ঘোরসংকটেও রেখে গেছেন সুন্দর একটি প্রাণ!’ তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়ানন্দ। এবার রূপালি নৌকার যাত্রীরা এসে ফুলজানকে টেনে তাদের নৌকায় তুলে ফেলল। ফুলজান বারংবার তাদের বলছে, সে কাঠের নৌকায় যাবে। সেখানে তার শিশুসন্তান রহমত আছে। রূপার নৌকায় তার দরকার নেই। কিন্তু রূপালি নৌকার কেউই তার কথা শুনল না।
নৌকা দুটি এবার বনমালীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। নোনগলা খাল, আত্রাই নদী পেরিয়ে বনমালী গ্রামে সমশেরের বাড়ির ঘাটে এসে পৌঁছাল। গ্রামের লোকজন আগেই খবর পেয়ে বেপারী বাড়িতে জড়ো হয়েছিল। নৌকা দুটি দেখে তাদের অনেকে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিল। দৌঁড়ে এল শমসেরও। মাত্রই সে গাঁওয়াল থেকে ফিরেছে। প্রথমেই সে এবার দৌঁড়ে গেল ফুলজানের কাছে। সে ফুলজানকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল। উঠানভর্তি মানুষ সেই দৃশ্য দেখে অশ্রুসিক্ত হল। করিম মুন্সীর কোলে ছিল রহমত। মুন্সী এবার রহমতকে শমসেরের কোলে তুলে দিল।
ফুলজান তার স্বামীর এই কান্নার কোনো অর্থ খুঁজে পেল না। তার স্বামীর ত আজ কান্নার কথা নয়। সে ত তার শিশুসন্তান রহমতকে গুটিবসন্তের টিকা দিয়ে নিয়ে এসেছে। রহমতকে হেলেঞ্চা বিলের ভয়াল ঝড়ের কবল থেকেও বাঁচিয়ে এনেছে। ঝড়ের সময় তাকে এতটুকু ভয় পেতে দেয়নি সে। কয়েক ঘন্টা সে অথৈ বিলের অকূল পাথারে নিজের জীবন বাজি রেখে পাহাড়সমান ঢেউ আর বজ্রঝড় মোকাবিলা করে স্বামীর আমানত রহমতকে সে রক্ষা করেছে। তারপরও তার স্বামী কেন কাঁদবে?
ফুলজানের এসব অসহায় প্রশ্নের কেউ কোনো উত্তর কেউ দিল না। সে অস্থির হয়ে উঠল। নিরুত্তর স্বামী, নিরুত্তর পাড়া-প্রতিবেশী। নিরুত্তর পৃথিবী। ক্রমেই দম বন্ধ হয়ে উঠল ফুলজানের।
রূপালি নৌকার মাঝি-মাল্লারা এবার ফুলজানের কাছে এল। তারা আবারও তাকে তাদের নৌকায় তুলে নিল। ফুলজান বারবার অনুনয়-বিনয় করে বলতে লাগল, কেন তাকে আবারো নৌকায় তোলা হচ্ছে। সে এখন রহমতের কাছে থাকবে। তার ভয় কাটাতে হবে। সে এ মূহুর্তে আর কোথাও যেতে চায় না। কিন্তু রূপালি নৌকার মাঝি-মাল্লারা কেউ তার কথা শুনল না। সে তার গলার স্বর তীব্রতর করে আকুতি জানাল। তারা কথা শুনল না। সে তার স্বামী শমসেরকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল, আমি রহমত আর আপনাকে রেখে কোথাও যাব না।
শমসের এ কথার কোনো জবাব না দিয়ে শিশুর মতো কাঁদতে লাগল। ফুলজান তার বাবার পায়ে গিয়ে লুটিয়ে পড়ল। তিনিও কোনো জবাব না দিয়ে বারবার মূর্ছা গেলেন। কিন্তু মেয়েকে আটকানোর কোনো চেষ্টাই তিনি করলেন না।
নিরুপায় ফুলজান দেখল পৃথিবী বড় নিষ্ঠুর আচরন করছে তার সঙ্গে। প্রিয়তম স্বামী, প্রাণপ্রিয় জন্মদাতা বাবা যেখানে তার প্রতি উদাসীন, সে আর কার কাছে যাবে? ফলে সে পাড়া-প্রতিবেশিদের কাছে আর গেল না।
রূপালি নৌকার প্রধান মাঝিটি এবার এসে ফুলজানকে কাধে তুলে নিল। ফুলজান এবার কোনো বাঁধাই দিল না। ফুলজানকে আবার রূপালি নৌকায় তোলা হল। নৌকাটি এবার আর পানি দিয়ে নয়, আসমানের দিকে তীব্র বেগে ছুটে চলল। ফুলজান নিচে তাকিয়ে দেখল, সাজানো গোছানো মায়াময় সুন্দর পৃথিবীটি ক্রমেই ধূসর হয়ে দূর থেকে আরো দূরান্তে সরে যাচ্ছে। বাবা, মা, স্বামী, সন্তান, পাড়া-প্রতিবেশীর মুখগুলো ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে সেই ধূসরতার অতলে হারিয়ে যাচ্ছে।